নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি মামলায় নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার কাগজপত্র এবং ইনজুরি সার্টিফিকেট বা জখম-সংক্রান্ত সনদপত্র জমা দেওয়া হয়। তবে তদন্তে নেমে সেই সব কাগজপত্র নিয়ে পুলিশের সন্দেহ হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেগুলো জাল। অথচ ভুক্তভোগী দাবি করছেন, তিনি মারধরের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকেই সনদ নিয়েছেন।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, হাসপাতালেই সক্রিয় জালিয়াতির একাধিক চক্র। তারা দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় নকল সনদ বানিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে মামলা করার প্রয়োজনে সংশ্নিষ্টরা জেনে-বুঝেই এই সনদ নিচ্ছেন। আবার না বুঝেও আসল ভেবে টাকার বিনিময়ে সনদ নিচ্ছেন কেউ কেউ। ঢাকার লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার কয়েকটি ঘটনায় এমন সনদের ব্যবহার দেখা গেছে। এমনকি দগ্ধ না হয়েও বার্ন ইউনিটের সনদ জমা দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নিশাত রহমান মিথুন বলেন, সম্প্রতি একটি মেডিকেল সনদ নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে তা যাচাইয়ের অনুরোধ করা হয়। তারা জানান, এমন কোনো সনদ তারা দেয়নি। সেটিতে উল্লেখ করা কোনো তথ্যই ঠিক নয়। শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, এ রকম আরও কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া সনদ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল ঘিরে সক্রিয় প্রতারক চক্র এসব সনদ তৈরি করে দেয়। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

সমকালের হাতে আসা একটি মেডিকেল সনদে দেখা যায়, লালবাগের নবাবগঞ্জ লেনের সুমাইয়া হক মারধরে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর দেওয়া ওই সনদে একজন চিকিৎসকের স্বাক্ষর ও সিল রয়েছে। এটি লালবাগ থানার একটি মামলায় সংযুক্ত করা হয়। সম্প্রতি পুলিশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা যাচাই করে লালবাগ থানার ওসির কাছে চিঠি পাঠায়। গত ৭ মার্চ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আশরাফুর নাহার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, লালবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় রোগী সুমাইয়া হকের প্রাথমিক টিকিট রেজিস্ট্রার খাতা যাচাই করে দেখা যায় তথ্যাবলি সঠিক নয়। এ ছাড়া জখমি সনদপত্রটি সঠিক নয় ও স্মারকবিহীন সনদপত্রটি এই হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয়নি।

এ বিষয়ে সুমাইয়া হকের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তার দাবি, তিনি প্রতারণার শিকার। ঘটনার দিন তিনি নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি বহির্বিভাগের টিকিট কেটে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে এক যুবক নিজেকে হাসপাতালের কর্মী পরিচয় দিয়ে বলেন, আপনারা মামলা করতে গেলে মেডিকেল সনদ লাগবে। তখন তারা সনদ দেওয়ার অনুরোধ করলে ওই যুবক জানান, সেটি পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। তবে দুই হাজার টাকা দিলে তিনি সহজেই তা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এরপর তাকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর ঘণ্টাখানেক পর তিনি একটি মেডিকেল সনদ এনে দেন। সেই সনদটিই মামলার সঙ্গে জমা দিয়েছেন। সনদটি যে জাল তা তিনি জানতেন না। তবে পরে পুলিশের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। একাধিক কর্মকর্তাকে তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তখন কর্মকর্তারাই বলেছেন, তিনি না বুঝে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এই সনদ দেয়নি।

সুমাইয়া জানান, স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি মামলাটি করেছিলেন। তবে পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। এ কারণে তিনি মামলাটিও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

ঢামেক সূত্র জানায়, হাসপাতালের অসাধু কয়েকজন কর্মচারী ও বহিরাগত একটি চক্রের যোগসাজশে এ ধরনের ভুয়া সনদের কারবার চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগীরা যোগাযোগ করে এসব সনদ নেন। আবার বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই এমন অনেককে ভুল বুঝিয়েও টাকার বিনিময়ে এই সনদ দেওয়া হয়।