পোশাকের দাম কমানোর প্রতারণামূলক লোভনীয় অফার, যৌক্তিক দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম নেওয়া, দামি ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করা, ওজনে কম দেওয়া, পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করাসহ নানাভাবে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যেই এ ধরনের শত রকমের চাতুরতা দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে ঘিরে এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

এসব অনিয়ম রুখতে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিদিনই ভোগ্যপণ্যসহ নানা খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করছে। তবুও থামছে না অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। এ পরিস্থিতিতে আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে অধিদপ্তর। জরিমানার পাশাপাশি মামলা ও কারাদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

ভোক্তা-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আইনে শিথিল প্রয়োগ ও নৈতিকতার অভাবে অতি লোভী হয়ে উঠছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তাদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনের আরও কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের কেউ ক্রেতাদের কাছ থেকে আসল পণ্যের দাম নিয়ে নকল পণ্য দিচ্ছেন। আবার কেউ টাকা নিয়েও পণ্য দিচ্ছেন না। কেউবা আবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যপণ্য তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করছেন। কেউ খাদ্যে মেশাচ্ছেন ভেজাল। অনলাইন এবং প্রথাগত- দুই ধারাতেই যে যার মতো করে ফাঁদ পাতছেন। এসব অনিয়মের মধ্য দিয়ে ভোক্তার পকেট কাটছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। সারা বছরই কমবেশি এ ধরনের অনিয়ম হলেও গত কয়েকদিন তা ব্যাপক হারে বেড়েছে।

সাম্প্রতিক অভিযানে নানা ধরনের অনিয়ম ও অপরাধের প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের আইআরও নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একজন ক্রেতা ৫০ শতাংশ ছাড়ে দুই হাজার ৪৯০ টাকা দিয়ে একটি পাঞ্জাবি কেনেন। পরে তিনি বাসায় গিয়ে দেখেন ওই পাঞ্জাবির ভেতরে তিনটা ট্যাগে তিন ধরনের দাম রয়েছে। প্রথমটিতে লেখা রয়েছে দুই হাজার ৪৯০ টাকা, তার নিচে দ্বিতীয়টিতে লেখা এক হাজার ৭৯০ এবং সবচেয়ে নিচে তৃতীয় ট্যাগে লেখা এক হাজার ১৯০ টাকা। এ তথ্য দেখে তিনি ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। অধিদপ্তর সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটি পোশাকের কোনোটিতে তিনটি, আবার কোনোটিতে দুটি দাম লেখা দেখতে পায়। পরে তাদের জরিমানা ও সতর্ক করা হয়।

এভাবে গত এক মাসে বেশ কয়েকটি অনিয়ম পাওয়া গেছে। গত ২০ এপ্রিল বনশ্রীতে অবস্থিত পোশাক ব্র্যান্ড আর্টিসানের শোরুমে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। দেখা যায়, চারগুণ লাভে পোশাক বিক্রি করেছে আর্টিসান। একটি শার্টের প্যাকেটের গায়ে লেখা ১৬৯৫ টাকা। কিন্তু ভেতরে ট্যাগে লেখা ১১৯৫ টাকা। এ ছাড়া কোনো কোনো প্যাকেটের গায়ে লাগানো 'পণ্যমূল্য এবং বারকোড' মুছে দেওয়া হয়েছে কালি দিয়ে।

অস্বাভাবিক মূল্য আদায় করার প্রমাণ পাওয়া গেছে মিরপুরের বেনারসিপল্লিতেও। সেখানে মিতু কাতান শাড়ি ঘরে ১৭০০ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে ১৭ হাজার টাকায়। গোপন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৬ এপ্রিল সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। একই জায়গায় ও তাওছিফ বেনারসি ফ্যাশনে তদারকি করে দেখা যায়, তাদের কাছে কোনো ক্রয় রসিদ নেই। ক্রেতাকে বিক্রয় রসিদও দেওয়া হয় না। শাড়িতে দেওয়া স্টিকারে এসএল নম্বর ও কোড দেওয়া থাকলেও কোনো মূল্য লেখা নেই।

এসএল অনুযায়ী বালাম বই চেক করে দেখা যায়, ইচ্ছেমতো ক্রয়মূল্য লিখে রেখেছেন বিক্রেতারা। ক্রয়মূল্যের পক্ষে কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেননি তারা।

জুতা তৈরিতেও চাতুরতা দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের। রাজধানীর পোস্তা এলাকায় নামকরা ব্র্যান্ড বাটা জুতার নাম নকল করে 'বালা' ও এপেক্সের নাম পরিবর্তন করে 'এডেক্স' ও এপক্স জুতা তৈরা করা হচ্ছে। বাটা এবং এপেক্সের আসল লোগো নকল করে বিভিন্ন জুতায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে স্বর্ণালঙ্কারের মাপে কারচুপি ধরা সম্ভব নয়। তাই এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ক্রেতারা। সম্প্রতি গুলশানের পিংকসিটিতে স্বর্ণ ও ডায়মন্ড মাপার যন্ত্রে ত্রুটি পেয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর। পরে তা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া নকল কসমেটিকস ও দাম বেশি নেওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়।

খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানো, ওজনে কম দেওয়া ও কয়েকগুণ দাম বেশি নেওয়া যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। গত ৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। ওই রাতে লেবু ও বেগুন বহনকারী ট্রাকের চালকদের সঙ্গে কথা বলে অধিদপ্তর জানতে পারে, প্রতি হালি লেবুর ক্রয়মূল্য পড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। কিন্তু সেই লেবু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। বেগুন বহনকারী একটি ট্রাকের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তরবঙ্গ থেকে প্রতি কেজি বেগুন ৩০ থেকে ৪০ টাকায় কেনা হয়েছে। ওই রাতেই পাইকাররা সেই বেগুন বিক্রি করেছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। পরের দিন কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় খুচরা পর্যায়ে ১০০ টাকা কেজি দরে বেগুন বিক্রি করতে দেখেছে সমকাল।

সম্প্রতি কামরাঙ্গীরচরে নোংরা পরিবেশে সেমাই উৎপাদন করতে দেখা গেছে আশার আলো ও মিতালি সেমাই নামের দুটি কারখানাকে। পরে জরিমানার পাশাপাশি তাদের সতর্ক করা হয়।

ঢাকার পাশাপাশি এভাবে সারাদেশে চলছে ভোক্তাদের নানাভাবে ঠকানোর প্রতিযোগিতা। অধিদপ্তর জানায়, গত ২১ এপ্রিল রাজশাহী জেলায় রাজশাহী মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে ১৯০ টাকায় ১ কেজি ৪০০ গ্রাম দই কিনেছিলেন সৈয়দ মাহমুদ আহমেদ নামের এক ক্রেতা। পরে ওজন নিয়ে মনে সন্দেহ দেখা দিলে তিনি অন্য জায়গায় ওজন করে দেখেন তাতে রয়েছে ১ কেজি ১০০ গ্রাম। গত ৩০ জানুয়ারি ২৮ টাকা মূল্যের একটি ইনজেকশন ১০০ টাকায় বিক্রি করেন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল গেটে চন্দন ফার্মেসির মালিক ফরিদ উদ্দিন।

অধিদপ্তর বলছে, কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে জরিমানা করার পর আবারও একই অপরাধ করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৫৭ ধারা অনুযায়ী, মামলা দায়ের হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে অধিদপ্তরের।

এ বিষয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহম্মদ শাহরিয়ার সমকালকে বলেন, ভোক্তাদের স্বার্থে আরও কঠোর হচ্ছে অধিদপ্তর। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার পরও অনিয়ম কমেনি। তাই ঈদের পর শুধু জরিমানা নয়, আইন অনুযায়ী অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফার পেছনে ছুটছে। তাদের মধ্যে যে নৈতিকতা থাকা দরকার তা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না। তবে ভোক্তা অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক অভিযানে বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এই অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, পণ্যের মান, ভেজাল, নকল পণ্য ইত্যাদি প্রতিরোধে আইন আছে। তবে মুনাফা নির্ধারণেও যুগোপযোগী আইন থাকা দরকার।