- বাংলাদেশ
- মহাসড়কে ডাকাতের দাপট
মহাসড়কে ডাকাতের দাপট

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাইজখার গ্রামের সৌদি প্রবাসী ফারুক হাওলাদার ১৩ বছর পর দেশে ফেরেন গত ১৯ মার্চ। ওইদিন ঢাকা থেকে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ প্রাইভেটকারে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর কিউট পল্লীর সামনে 'প্রকৃতির ডাকে' সাড়া দিতে গাড়ি থামান। এ সময় ছয়-সাতজনের ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার বিদেশি মালপত্র ভর্তি স্যুটকেস, নগদ ১২ হাজার টাকা ও এক হাজার ৪০০ সৌদি রিয়াল নিয়ে যায়।
এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁয়ের মেঘনা ঘাট থেকে ফ্রেশের সুগার মিল থেকে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার জন্য একটি ট্রাক রাত সাড়ে ১১টার দিকে রওনা হয়। রাত পৌনে ২টার দিকে পাকুন্ডা এলাকায় ট্রাকটির চালক আফজাল হোসেন ও হেলপার সোহাগকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চিনিভর্তি ট্রাকটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
এভাবে কয়েক মাস ধরেই দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে একের পর এক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে বাস-ট্রাকসহ পরিবহন সংশ্নিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। নিরাপত্তা জোরদার না হলে আসছে ঈদে ডাকাত চক্র আরও বেপরোয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্নিষ্টদের।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনে ডাকাতির শিকার হয়ে জাতীয় জরুরি সেবা '৯৯৯'-এ কল করেছেন ২৪৮ জন। দৈনিক প্রায় তিনটি ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডাকাতের কবলে পড়ে পুলিশের তাৎক্ষণিক সহায়তা চাওয়া কলের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪৩৩টি। যদিও ডাকাতির প্রকৃত ঘটনা এর চেয়ে অনেক বেশি।
কারণ, অধিকাংশ ভুক্তভোগী ডাকাতির শিকারের পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ দিতে যান না। অনেক সময় পুলিশও মামলা নিতে চায় না।
ডাকাতির শিকার প্রবাসী ফারুক হাওলাদারের স্ত্রী খোদেজা বেগম বলেন, 'স্বামীর আয় রোজগার কেড়ে নিলেও তিনি অক্ষত ছিলেন, এটাই শুকরিয়া। পুলিশ সতর্ক হলেই প্রবাসীরা নিরাপদে বাড়িতে ফিরতে পারত।'
চিনিসহ ছিনতাই হওয়া ট্রাকের চালক আফজাল হোসেন বলেন, সোনারগাঁ সড়কে প্রায়ই ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সড়কে পুলিশের টহল জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহনের কর্ণধার খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, নাইট কোচে যাতে ডাকাতির ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। বাসে ওঠানোর সময় সব যাত্রীর ভিডিও করা; আবার হোটেলে বিরতির পর ফের গাড়ি চালু হওয়ার সময় যাত্রীদের ছবি তোলা। এ ছাড়া নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া কোথাও গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নামানো ও ওঠানো যাবে না।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্য নির্বাহী সদস্য কাজী ফরিদুল হক হ্যাপি বলেন, হাইওয়ের নিরাপত্তার জন্য এখন স্বতন্ত্র হাইওয়ে পুলিশ ইউনিট রয়েছে। তাদের সদিচ্ছা এবং তৎপরতা থাকলে ডাকাতরা খুব বেশি সক্রিয় হওয়ার সাহস দেখাবে না।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মল্লিক ফখরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কুমিল্লার চান্দিনাসহ কয়েকটি এলাকায় রড ছিনতাইকারী চক্র আছে। তারা মহাসড়কে হঠাৎ বিকট শব্দ তৈরি করে। চালকরা চাকা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কায় গাড়ি থামান। তখন ডাকাতির শিকার হন। এ ধরনের অপরাধে কয়েকটি চক্রকে ধরেছি। আর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সব বাসে পুশ বাটন নামে একটি ইলেকট্রিক ডিভাইস লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৩০-৩৫টি জায়গায় প্রায়ই ডাকাতি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে কাঁচপুর, আশুলিয়া, এলেঙ্গা, চম্পাগঞ্জ, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, কবিরপুর, বাইপাইল, নবীনগর, সাভার, হেমায়েতপুর, গেন্ডা, চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, ধামরাই, কামালপুর, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ। কোনো কোনো সড়কে যানজট দেখা দিলে তখন গণছিনতাই ও গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। মহাসড়ককেন্দ্রিক আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ১৫ থেকে ২০টি গ্রুপ এ কাজে সক্রিয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক-মহাসড়কে ঘুরেফিরে ডাকাতি করে- এমন পেশাদার ৪০ জনের নাম-পরিচয় পেয়েছে পুলিশ। কর্মকর্তারা জানান, ডাকাত ও ছিনতাই চক্রের সদস্যদের প্রধান টার্গেট হলো পণ্যবাহী গাড়ি। এ ছাড়া যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরাও তাদের শিকার। কিছু কিছু সড়কে ঢিল ও ডিম পার্টিও সক্রিয়। গাড়িতে ঢিল ছুড়ে ও ডিম মারার পর চালক যখন সেটি থামান, তখন সহযোগীদের নিয়ে যাত্রীদের সব কিছু কেড়ে নেওয়া হয়।
গত ছয় মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে মেঘনা ঘাট ও এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের গোলাকান্দাইল থেকে মদনপুরে ১২টি ডাকাতি ও সাতটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পরিবহন মালিক ও সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দুই সড়কের প্রায় ২১ কিলোমিটার সড়ক রাতে দাপিয়ে বেড়ায় ছিনতাই ও ডাকাত চক্র। এই ১৯টি ঘটনার মধ্যে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে আটটি ঘটনায়। বাকি ঘটনাগুলোতে কেউ অভিযোগ দায়েরের আগ্রহ দেখাননি।
নারায়ণগঞ্জের সোনাখালী এলাকার কফিল উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী গত ২১ জানুয়ারি রাত দেড়টার দিকে ঢাকা থেকে বাসায় ফিরছিলেন। পথে সোনাখালী বাসস্ট্যান্ডে সাত-আটজনের একটি দল সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে এসে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার ব্যাগে থাকা আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। কফিল উদ্দিন জানান, পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তিনি থানায় অভিযোগ করেননি।
এ ছাড়া গত ২৪ জানুয়ারি রাতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইস্পানির চর এলাকার তৌহিদুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ইউটার্নে পাঁচ-ছয় যুবক গতিরোধ করে ৫৭ হাজার টাকা, স্বর্ণের চেইন, আংটি ও দুটি মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নেয়।
গত ২৮ মার্চ রাতে মো. জিহাদ নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কাঁচপুর বিসিকের সামনে তার লাশ পাওয়া যায়। জিহাদের বিরুদ্ধে সোনারগাঁ থানায় ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশের ধারণা, ডাকাতির লুণ্ঠিত টাকা ভাগ ভাটোয়ারার দ্বন্দ্বে সে খুন হয়েছে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড থেকে ৬০ ড্রাম (একেকটি ২০৪ লিটার) খোলা সয়াবিন তেল কিনে ট্রাকে করে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী মশিউর রহমান। রাত পৌনে ১১টার দিকে নরসিংদীর শিবপুরের ইটাখোলা এলাকায় পৌঁছলে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় পাঁচ-ছয়জন একটি মাইক্রোবাস থেকে ট্রাক থামার সংকেত দেয়। 'পুলিশ' ভেবে চালক ট্রাক থামান। এর পরই ট্রাকের কাগজপত্র যাচাইয়ের নাম করে চালক ও সহকারীকে ট্রাক থেকে নামিয়ে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এরপর ট্রাকভর্তি তেল ডাকাতরা নিয়ে যায়।
বিভিন্ন মহাসড়ক থেকে গরুবোঝাই ট্রাক ডাকাতির তথ্যও পাওয়া গেছে। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট থানার ফলিমারি বিল এলাকার সড়কে ঢাকাগামী তিনটি বাসে গতিরোধ করে যাত্রীদের মধ্যে লুটপাট চালায় ডাকাতরা। এ সময় অস্ত্রধারী ডাকাতরা পরিবহনকর্মী ও যাত্রীদের বেদম মারধর করে। ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়েতে একটি বাসে ডাকাতির পাশাপাশি নারী ও শিশুদের নির্যাতন করে ডাকাত দল।
জানতে চাইলে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ সাজ্জাদ করিম খান দাবি করেন, মহাসড়কের ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশ আশপাশের সব থানা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের শিকারের পর মামলা করতে গেলে পুলিশের রশি টানাটানি শুরু হয়। ঘটনাস্থল নিজ নিজ থানা এলাকার মধ্যে পড়েনি- এটা দাবি করে ভুক্তভোগীর মামলা নেওয়া হয় না। একাধিক থানা ঘুরে ভুক্তভোগীরা হতাশ হন। এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শফিকুল ইসলাম। ২০ জানুয়ারি রাতে বাসে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে কর্মস্থলে ফিরতে গিয়ে ডাকাতির শিকার হন তিনি। ডাকাতরা তার কাছ থেকে সাত-আট হাজার টাকা, তিনটি মোবাইল ফোনসেট, দুটি ডেবিট কার্ড ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। সেই সঙ্গে তার ওপর চালায় ভয়াবহ নির্যাতন। যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পশ্চিম থানার টানাটানির কয়েক দিন পর ওই চিকিৎসক মামলা করেন।
সাবেক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ডাকাতি ও ছিনতাই কোনো এলাকায় সংঘটিত হলে তা সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এ জন্য ওই এলাকার পুলিশকে তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তাই অনেক ঘটনায় মামলা নিতে চায় না পুলিশ। 'হারানোর' সাধারণ ডায়েরি করা হয়।
মন্তব্য করুন