ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৬ মাসে (২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) মোট মামলা হয়েছে ৮৯০টি, অভিযুক্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৪৪ জন এবং আটক হয়েছেন ৮৪২ জন। গড়ে প্রতি মাসে অভিযুক্ত ৮৬ জনের বেশি। আটক হয়েছেন গড়ে ৩২ জন। আর প্রতি মাসে গড় মামলার সংখ্যা ৩৪টি।

তবে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে অভিযুক্ত হয়েছেন ১৪৭ জন এবং আটক হয়েছেন ৬৭ জন করে। সবচেয়ে বেশি মামলার শিকার ও আটক হচ্ছেন রাজনীতিবিদ (২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ) এবং সাংবাদিক (১৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ)। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দলের নেতা-কর্মীরা।

শনিবার সেন্টার ফর গভর্নমেন্ট স্টাডিজ আয়োজিত ওয়েবিনারে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা কার্যক্রমের মুখ্য গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর এবং সিজিএস-এর উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ড. আলী রীয়াজ।

'অন্তহীন দুঃস্বপ্ন- বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট ২০১৮' শিরোনামে আয়োজিত এ ওয়েবিনারে আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন- এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল। এতে সভাপতিত্ব করেন সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী এবং সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত অভিযুক্ত হয়েছেন ৯১৩ জন, আটক হয়েছেন ২৭৩ জন এবং মামলার সংখ্যা ৪২৬টি। মাসে গড়ে অভিযুক্ত হয়েছেন প্রায় ৬০ জন, আটক ১৮ জন। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ফেরুয়ারি পর্যন্ত অভিযুক্তের সংখ্যা ১৩৩১ জন। আটক হয়েছেন ৬০৯ জন এবং মামলার সংখ্যা ৪৬৪টি। মাসে গড়ে অভিযুক্ত হয়েছেন ১৪৭ জন করে। আটক ৬৭ জন এবং মামলা হয় ৫১টির বেশি।

অভিযুক্তদের পেশা সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, মোট পেশা পাওয়া গিয়েছে ৮২০ জনের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেশার মানুষ হচ্ছেন রাজনীতিবিদ (২৫৪ জন) এবং পরবর্তীতে আছেন সাংবাদিক (২০৭ জন)।

অভিযুক্তদের বয়স বিবেচনায় উঠে আসে তরুণরাই এই মামলার দ্বারা সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদেরকেও অভিযুক্ত করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিকদের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, এই আইনের আওতায় সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত এবং আটক হয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। শিক্ষকরা এই আইনে অভিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আটক হচ্ছেন। এই আইনের অধীনে অভিযোগকারী কারা সেটি গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে।

সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করেন রাজনীতিবিদরা (৪০.৫৫%)। সরকারের সাথে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরাও মামলা করে থাকেন। যেমন-আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের সমর্থন আছে এই রকম মামলার পরিমাণ ৩০.৩১%।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অবমাননার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে ৯৮টি, মন্ত্রীর অবমাননার মামলা করা হয়েছে ৫১টি এবং রাজনৈতিক নেতাদের আবমাননার মামলা করা হয়েছে ৭৫টি। ফেসবুকে মতামত প্রকাশের জন্য এই আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে ৩৯৯টি।

ড. আলী রীয়াজ বলেন, এই আইন ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার। কারণ অভিযোগকারীর মধ্যে যাদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্নিষ্টতা আছে বলে চিহ্নিত করা গেছে তার মধ্যে ১৬৭ জন, অর্থাৎ ৮১ শতাংশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে ২৫ এবং ২৯ ধারায় এবং সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত রয়েছে ৩৫ ধারায়। এই ধারাগুলোর অপব্যবহার রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করেছে।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার জনগণের জন্য এক অন্তহীন দুঃস্বপ্ন তৈরি করেছে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনে মামলা দায়েরের বিষয়ে স্বচ্ছতা নেই। গণমাধ্যমে সব মামলার খবর প্রকাশিত হয়না। এমনকি পুলিশও সহায়তা করে না। তথ্য অধিকার আইনের সাহায্য নিয়েও এই বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আসলে সরকারের মধ্যে ক্ষমতা হারানোর যে শঙ্কা কাজ করে সেই শঙ্কা থেকেই সরকার নিজেদের সুরক্ষার জন্য এই আইন প্রণয়ন করেছে।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু আইন কোথায় দরকার সেটা আগে বুঝতে হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রে সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের যে অধিকার দেওয়া হয় তা কর্তৃত্ববাদী সরকার আইন প্রণয়ন এবং সেসকল আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের এই অধিকার হরণ করে। এ সকল আইন সরকার যার বিরুদ্ধে চায়, তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে ইচ্ছামতো। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণের পর থেকে জনগণ কোনো আইনেরই সুফল ভোগ করতে পারছে না।

ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, এই আইনে রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। এখন জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তির অবমাননা আসলেই কোনো অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিনা। কারণ রাষ্ট্র এবং সরকার দু'টো পৃথক বিষয়। একইভাবে ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টিও সংজ্ঞায়িত নয়। যদি কারো অনুভূতি এমন ঠুনকো হয় যে, সেই ব্যক্তি কথায় কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তবে এই বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিতে হবে তার উল্লেখ থাকতে হবে।

ফারুখ ফয়সল বলেন, কোনো বিশেষ মতাদর্শকে অথবা সরকারি দলকে রক্ষা করার জন্য নয়, আইনের প্রয়োজন জনগণকে রক্ষা করার জন্য।

তিনি আরও বলেন, দেশে যে নতুন ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট এবং ডিজিটাল মিডিয়া ও ওটিটি রেগুলেশন আসছে, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেয়েও ভয়াবহ।

সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, মন্ত্রীরা এমনভাবে কথা বলেন যেন এই আইনগুলো নিজে নিজে সংসদে গিয়ে নিজে নিজে পাস হয়ে আসে। আসন্ন ওটিটি রেগুলেশনের ফলে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।