- বাংলাদেশ
- ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন
ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন

এ বছর নিজের ১৪ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন কৃষক ময়েন উদ্দিন। ধানও পেকে উঠেছিল। কিন্তু কয়েক দিনের থেমে থেমে ভারি ও মাঝারি বর্ষণে তার ওই ধানি জমিতে পানি জমে যায়। ক্ষেত থেকে তাড়াতাড়ি ধান কেটে আনতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ময়েন। কিন্তু কৃষিমজুরদের কথা শুনে মাথা ঘুরে যায় তার। পানি জমে যাওয়া জমির ধান কাটতে মোট ধানের অর্ধেক দাবি করে তারা।
শুধু কৃষক ময়েন উদ্দিন নন, তাড়াশের সব কৃষকেরই এখন মাথায় হাত পড়েছে। কারণ ধান কাটা মজুরের তীব্র সংকট চলছে সারা উপজেলায়। একদিকে চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে। দিনমজুররা তাই মজুরি দাবি করছে আকাশছোঁয়া। ধান কাটতে একজন কৃষি শ্রমিককে দিন হাজিরা হিসেবে দিতে হচ্ছে এক হাজার ৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ বিঘাপ্রতি ১৪ হাজার টাকা। অথবা পারিশ্রমিক হিসেবে দিতে হচ্ছে মণপ্রতি ১০ কেজি কাটা ধান।
সরকার থেকে অবশ্য কৃষি ভর্তুকির মাধ্যমে তাড়াশ উপজেলায় কৃষকদের ধান কাটার জন্য ২৬টি হারভেস্টার মেশিন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে পানিতে ডুবে যাওয়া অথবা নুয়ে পড়া ধান কাটা যাচ্ছে না। এতে ধান কাটার সংকট আরও বেড়েছে।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ভারি বর্ষণে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার অধিকাংশ পাকা ধানের জমিতে পানি জমে যাওয়ায় নতুন করে ডুবতে বসেছে কৃষকের স্বপ্নের পাকা বোরো ধান।
স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শস্য ভান্ডারখ্যাত চলনবিলের আওতাভুক্ত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় চলতি বছর ২৪ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। বর্তমানে ওইসব জমিতে চলছে ধান কাটার ভরা মৌসুম। কিন্তু কৃষি শ্রমিকদের মজুরি মেটাতে স্থানীয় কৃষকদের নাভিশ্বাস উঠছে। তাদের মতে, জমির বোরো ধান কাটতে কৃষি শ্রমিকদের বর্তমানে যে হারে পারিশ্রমিক দিতে হচ্ছে, তাতে বেশিরভাগ কৃষকেরই উৎপাদন ব্যয় না ওঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিন তাড়াশ উপজেলার তালম, সগুনা, মাগুড়া বিনোদ, তাড়াশ সদর, নওগাঁ ও বারুহাস ইউনিয়নের ফসলি মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জমিতে পানি জমে ধান নুয়ে পড়েছে। ফলে হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা যাচ্ছে না।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের এই মৌসুমে সেখানকার ভোলাহাট উপজেলাও দেখা দিয়েছে চরম শ্রমিক সংকট। অতিরিক্ত ধান বা টাকা দিয়েও ধান কাটা ও মাড়াইয়ের শ্রমিক মিলছে না। এরই মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির কারণে কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে মাঠের পাকা ধান।
বিলভাতিয়ায় গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিক না পেয়ে জমির ধান নিজেই কাটছেন শহিদুল ইসলাম। ইলেকট্রিশিয়ান শহিদুল ১২ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কৃষিশ্রমিক না পাওয়ায় দোকান বন্ধ রেখে আত্মীয়-স্বজন ও ভাইকে নিয়ে ধান কাটছেন তিনি। মাড়াইয়ের কাজটিও তাদেরই করতে হবে।
অন্যদিকে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ঘূর্ণিঝড় 'আসানি'র প্রভাবে সেখানে থেমে থেমে মাঝারি ও ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় পাকা ধান কাটতে পারছেন না কৃষকরা। রোদ না থাকায় কাটা ধানও পারছেন না শুকাতে। ধানের স্থানীয় বাজারমূল্যও আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে, সর্বোচ্চ ৭০০ টাকায় নেমে এসেছে। এতে হতাশ কৃষকরা। এদিকে সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হলেও বৈরী আবহাওয়ায় ধান ভালো করে শুকাতে না পারায় অনেক চাষিই সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না।
এদিকে বৃষ্টির কারণে ধানিজমিতে হাঁটুপানি জমে গেছে। অন্যদিকে জমিতে রাখা কাটা ধানে অঙ্কুরোদগম ঘটছে। এতে ওই ফসলের ৫০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। অনেক জমির ধান কালবৈশাখীতে নুয়ে পড়ায় ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে।
আগৈলঝাড়ায় এবার ধানের ফলন ভালো হলেও গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা, বাগেরহাট, শরণখোলা, মোরলগঞ্জ, পিরোজপুর জেলা-উপজেলার ধানকাটা শ্রমিকরা এসেছে গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এ অবস্থায় শ্রমিক সংকটও দেখা দিয়েছে। কিছু পাকা ধান কাটা হলেও বৃষ্টির কারণে ধানের খর-কুটা পচে যাওয়ায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দেবে বলে মনে করছেন চাষিরা।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আগৈলঝাড়া (বরিশাল), তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি।
মন্তব্য করুন