- বাংলাদেশ
- ডেসটিনির মামলায় 'লঘু' শাস্তি আইনের দুর্বলতায়
ডেসটিনির মামলায় 'লঘু' শাস্তি আইনের দুর্বলতায়

গ্রাহকের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ ৪৬ আসামি 'লঘু' শাস্তি পাওয়ায় বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা জরুরি। টাকা ফেরত না পাওয়ায় আসামিদের এই লঘু শাস্তি অপরাধকেই বরং উৎসাহিত করবে।
আইনজীবীরা বলছেন, 'দুর্বল' আইনের কারণেই আসামিরা লঘু শাস্তি পাচ্ছেন। কারণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ২০১২ অনুযায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করলেও সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ বছর। এ জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা উচিত।
এর আগে কয়েক দফায় মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করার তাগিদ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিল যুবলীগের বহিস্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার জামিনের বিষয়ে রুলের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, 'মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।' বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণ দেন।
মানি লন্ডারিং, অর্থাৎ অর্থ পাচার বিশ্বব্যাপী একটি বহুল আলোচিত অপরাধ। বাংলাদেশেও গত দুই দশকে এর ব্যাপকতা বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করে সরকার। দুদক ও আদালতের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় প্রায় ৬০০ মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। যার মধ্যে বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ বহুল আলোচিত অনেক অর্থ পাচারের ঘটনা রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তাধীন।
আলোচিত ডেসটিনি মাল্টিপারপাস সোসাইটির দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় গতকাল রায় দেন ঢাকার আদালত। রায়ে রফিকুল আমীনকে সর্বোচ্চ ১২ বছর, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং অন্য ৪৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
এ রায়ের পর মানি লন্ডারিং আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, 'আমরা আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আদালত আইনের ভিত্তিতেই ডেসটিনি মাল্টিপারপাসে দুর্নীতির ঘটনায় আসামিদের সাজা দিয়েছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির যে বিষয়টি আছে, অর্থাৎ ১২ বছর, এটি পরিবর্তন হওয়া দরকার। অপরাধের প্রকারভেদ, অর্থাৎ কেউ যদি এক লাখ টাকা পাচার করে, তার জন্য এক রকম; আবার কেউ যদি এক হাজার কোটি টাকা পাচার করে, তার জন্য যেন সে অনুযায়ী সাজা নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন পর্যন্ত হওয়া উচিত।'
ডেসটিনির আসামিদের লঘু শাস্তি প্রসঙ্গেদুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, 'আইনে সর্বোচ্চ শাস্তিই ১২ বছর। এর চেয়ে কম যাদের সাজা দেওয়া হয়েছে, তাদের বিষয়ে লিখিত রায় পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে আপিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, 'হাইকোর্ট বিভিন্ন সময়ে মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু এখনও সেটি হয়নি। বিদ্যমান আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।'
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'আইনটি আরও শক্তিশালী করা দরকার। শুধু আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলেই হবে না; প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের যে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে, তা-ও ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি মোটেই হচ্ছে না। বরং পাচার করা টাকা অপরাধীদের পরিবার-পরিজন বিদেশে ভোগ করছে।'
মন্তব্য করুন