বর্তমান সময়ে পারিবারিক বন্ধনে সবচেয়ে বড় সংকট পারস্পরিক আস্থার অভাবকে মনে করা হয়। পারস্পরিক আস্থার অভাবে পারিবারিক কলহ বাড়ছে, যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে, হচ্ছে বিচ্ছেদ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু পারিবারিক শিক্ষায় আমরা কতটুকু শিক্ষিত হতে পারছি। এই আস্থার সংকটের মূল কোথায়, সমাধানই বা কী? লিখেছেন শারমীন আক্তার সেতু

পরিবার ও নগরায়ণ- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে 'আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস'। এবারের দিবসের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো, একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবারবান্ধব নগরনীতি প্রণয়নের গুরুত্বের ওপরে সচেতনতা সৃষ্টি করা। পরিবার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। খুব সহজ ভাষায় পরিবার হচ্ছে; যেখানে দুই বা দুইয়ের অধিক ব্যক্তি জন্মসূত্রে, আত্মীয়তার সূত্রে বা বিয়ে সূত্রে একসঙ্গে বসবাস করে।

নগরায়ণ ও বিশ্বায়নের প্রভাবে পারিবারিক কাঠামো ও পরিবারের ধারণায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৃহৎ পরিবারের ধারণা থেকে ক্রমেই মানুষ ক্ষুদ্র পরিবারের ধারণায় আকৃষ্ট হচ্ছে। এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে নগরায়ণ একটি অন্যতম কারণ।

ধীরে ধীরে মানুষ জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে এবং কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। ফলে পারিবারিক কাঠামোতে এর একটি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যৌথ পরিবারের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, কৃষিকাজে অনেক মানুষের শ্রম প্রয়োজন হয়। নগরায়ণের পাশাপাশি পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তনের পেছনে পরিবর্তিত জলবায়ুও একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রতিকূল জলবায়ুর কারণে অপেক্ষাকৃত প্রত্যাশিত জীবনযাপনের জন্যও মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে- পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তনের কারণগুলো নিয়ে আলোচনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফারহানা জামান এভাবে তার অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। আরেকটু ভিন্ন আঙ্গিকে বলা যায়, বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তনের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বিশ্বায়নের প্রভাব। বিশ্বায়নের ফলে আমাদের চিন্তা, শিক্ষা, পছন্দ, চাহিদা সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে; যার একটি প্রভাব আমরা আমাদের পারিবারিক কাঠামোতে দেখতে পাচ্ছি এবং যৌথ ও একক উভয় পারিবারিক কাঠামোতেই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা বিদ্যমান। যৌথ পরিবার হোক বা একক পরিবার- এই আধুনিক পরিবার কাঠামোগুলোতে এখন কিছুটা পারিবারিক আস্থার সংকট দেখা যাচ্ছে। এতে করে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে এবং পারিবারিক কলহ পারিবারিক সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে মাঝে মাঝেই।

'রূপক (ছদ্মনাম) একজন চাকরিজীবী। বেশ কয়েক বছর ধরে তার পরিবারে সময় কাটাতে ভালো লাগে না। কারণ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে চিন্তাভাবনার মিল হয় না এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে সে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করে আনন্দ পায় না। তাই সে বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে কাটায়, পরিবারে ফিরতে ইচ্ছা করে না তার।'

'অর্পা (ছদ্মনাম) একজন কিশোরী। তার বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায়ই তার দ্বন্দ্ব ও কলহ হয়। কারণ তার বাবা-মা তার গোপনীয়তা রক্ষা করে না, স্বাধীনতা দেয় না। এই বয়সের মানসিক চাহিদা অনুযায়ী তাকে সঙ্গ দিতে পারে না। ফলে বাবা-মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে।'

আবার বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন সন্তানের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। ঘটনাগুলো বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বায়নের কারণে মানুষের জীবনযাত্রা এবং প্রত্যাশাতে পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি পারিবারিক নৈতিকতা, শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবেও ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে এই আস্থা, বিশ্বাস বা স্বস্তির জায়গা তৈরি না হওয়ার ফলে আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হওয়ার ফলে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে সুষ্ঠু বিনোদনের নিরাপদ ও যথাযথ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। নগরবাসীর মানসিক চাপ বা বিষণ্ণতা দূর করার জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা না থাকার ফলে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এত গেল পারিবারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে অনাস্থা তৈরির পেছনে কিছু কারণ। তাহলে সমাধান কী? আস্থার সম্পর্কগুলো আরও মজবুত করতে আমরা কিছু পদক্ষেপ চিন্তা করতে পারি :
আধুনিক মৌলিক সেবাগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর যেসব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেমন : মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আধুনিক বাসস্থান, আধুনিক হাসপাতাল, কলকারখানা, অফিস-আদালত, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্র ইত্যাদি নগরকেন্দ্রিক। এসব সেবা শুধু শহরকেন্দ্রিক না করে সব জেলা এবং উপজেলায় সমানভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্যই অধিকাংশ মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে নগরমুখী হয়। সুতরাং, জেলা এবং উপজেলাভিত্তিক কর্মসংস্থান ও নগরায়ণ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তাহলে মানুষ নিজ এলাকাতেই তার পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে, যা তাদের পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে সহায়তা করবে।
কর্মচারীবান্ধব কর্মনীতি প্রণয়ন
আমাদের যেসব কর্মনীতি রয়েছে, তা কর্মচারীদের অনেকটাই চাপগ্রস্ত করে রাখে। ফলে তারা পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। তাই অফিস-আদালত ও কলকারখানাগুলোতে কর্মচারীবান্ধব কর্মনীতি প্রণয়ন করা।

পারিবারিক মূল্যবোধ
প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একটি নৈতিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পরিবারও একটি আদি সংগঠন এবং প্রতিটি পরিবারে কিছু নিয়ম ও মূল্যবোধ থাকে, যার ওপর ভিত্তি করে সেই পরিবারটি টিকে থাকে। পরিবারে সুষ্ঠু ও উপকারী মূল্যবোধ ও পারিবারিক নিয়মনীতি প্রণয়ন করা এবং সেগুলোর চর্চা করা প্রয়োজন।

প্রজন্মগত মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন
একটি পরিবারে সাধারণত বিভিন্ন প্রজন্মের সদস্য থাকে, যাদের একে অপরের সঙ্গে চিন্তার এবং আচরণের পার্থক্য থাকতে পারে। সব প্রজন্মের সদস্যদেরই অন্য প্রজন্মের মানুষের চিন্তাধারাকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে।

ডিভাইস আসক্তি থেকে দূরে থাকা
বর্তমানে ডিভাইস আসক্তি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবারের সবাই হয়তো একসঙ্গে আছে কিন্তু সবাই যার যার ডিভাইস নিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যস্ত আছে। তাই কাছাকাছি থাকলেও একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা তাদের মধ্যে আবেগীয় শিথিলতা তৈরি করছে। তাই ডিভাইস আসক্তি থেকে বের হয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটাতে হবে।
ধীরে ধীরে মানুষ জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে এবং কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। ফলে পারিবারিক কাঠামোতে এর একটি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যৌথ পরিবারের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
-ফারহানা জামান
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের