মূল্যায়নের বাইরে ৬৯% সরকারি প্রকল্প
দেলওয়ার হোসেন
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ মে ২০২২ | ১৪:০৮
টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন প্রকল্পের সঠিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। কিন্তু এ কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত 'বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)' সময়মতো ও যথাযথভাবে তা করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের এডিপিভুক্ত এক হাজার ৬০০ প্রকল্পের মধ্যে ৫০০ প্রকল্প পরিদর্শন করার সামর্থ্য নেই। ফলে এক হাজার ১০০ বা ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের বাইরে থেকে যাবে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, দক্ষ জনবলের অভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জনবলের শূন্যতা পূরণে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল জনপ্রশাসন। তবে ডিসিরা এ কাজে প্রশিক্ষিত নন- প্রকৌশলীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেই নির্দেশ স্থগিত করা হয়েছে।
কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, একদিকে আইএমইডির নিজস্ব জনবল বৃদ্ধি ও মাঠ পর্যায়ে অফিস স্থাপনের কার্যক্রম ঝুলে আছে, অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনের বিশেষায়িত ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত করা হয়েছে। এই দুইয়ে মিলে এমন সংকট তৈরি হয়েছে।
আইএমইডি যে কোনো সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিবীক্ষণ, সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন এবং সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নে কাজ করে। এসব কাজ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতেন ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সংশ্নিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা নিয়োগ পেতেন এ ক্যাডারে। প্রকল্প সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা অর্জন করতেন দেশ-বিদেশে। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর বিসিএস প্রশাসন ও ইকোনমিক ক্যাডার একীভূত হওয়ায় এসব কাজে যুক্ত হয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
আইএমইডি সূত্রে জানা যায়, অ্যালোকেশন অব বিজনেসে-এর ৩২ (সি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সারাদেশের চলমান এডিপিভুক্ত প্রকল্প পরিদর্শন ও মূল্যায়ন করে আইএমইডি। স্বাধীনতার পর দেশের বাজেটের আকার বেড়েছে বহু গুণ। এডিপিভুক্ত প্রকল্পের সংখ্যাও বেড়েছে। এক যুগ আগের আইএমইডির জনবল বৃদ্ধি ও মাঠ পর্যায়ে অফিস স্থাপনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন না করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ডিসিদের দিয়ে প্রকল্প মনিটরিংয়ের জন্য গত ১৮ জানুয়ারি নির্দেশ দেয়। এর আগে ডিসি সম্মেলনে প্রকল্প দেখভালের ক্ষমতা চেয়ে প্রস্তাব পাঠান ডিসিরা। প্রকৌশলীদের সংগঠন আইইবির বিরোধিতার ফলে ডিসিদের সেই নির্দেশনা স্থগিত করা হলেও এডিপিভুক্ত প্রকল্প দেখভালের জন্য ডিসিদের সভাপতি ও এডিসিকে সদস্য সচিব করে নতুন একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রকল্প দেখভালে ফের নির্দেশনা :গত এপ্রিল মাসে বিভাগীয় কমিশনারের সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিসিদের নিজ নিজ জেলার প্রকল্প দেখভাল ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক বিভাগীয় কমিশনার এ চিঠি দিয়েছেন। পরিদর্শনের কাজ সহজ করতে 'আইএমইডি পিন' নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো মন্ত্রণালয়, সংস্থা, বিভাগ ও জেলা অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে। প্রকল্পের নাম, শুরু ও শেষের তারিখ, প্রাক্কলিত ব্যয় ও অবস্থানসহ প্রাথমিক তথ্য যুক্ত করা হয়েছে।
আইএমইডি সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, জনবলের অভাবে অনেক প্রকল্প পরিদর্শন করা যাচ্ছে না। এ জন্য ডিসিদের সম্পৃক্ত করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়। ডিসিরা যেন নিজ নিজ জেলার প্রকল্প সম্পর্কিত তথ্য আইএমইডিতে পাঠান। এ বছর বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) ৫০০ প্রকল্প পরিদর্শনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম সমকালকে বলেন, বর্তমানে জনবল যা আছে, তা দিয়েই কাজ করতে হবে। চাইলেই জনবল বাড়ানো যায় না। এটার একটা প্রক্রিয়া আছে, সময় লাগে। যতদূর সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। তবে জনবল বাড়ানোর জন্য কাজ চলছে।
ডিসিদের আইএমইডির কাজে যুক্ত করার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আইএমইডির জনবল ডিসিরা হবেন কী করে? ডিসিরা কি প্রকল্প সম্পর্কে প্রশিক্ষিত? সে যেটা করে তথ্য দিতে পারবেন। আর মূল্যায়নের দায়িত্ব তো আইএমইডির। জনবলের অভাব তো ডিসিদের দিয়ে পূরণ হবে। আইএমইডির জনবলের ধরন, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান যেটা দরকার, ডিসিদের তো সেভাবে তৈরি করা হয় না। ডিসি ও আইএমইডিকে মিশিয়ে ফেলা যাবে না। এ ছাড়া ইকোনমিক ক্যাডার প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হওয়ায় একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। এ গ্যাপ পূরণে তিনটি শর্ত মানতে হবে। এক. প্রশিক্ষণ, দুই. প্রশিক্ষণ ও তিন. প্রশিক্ষণ। যাঁরা আইএমইডিতে কাজ করবেন, তাঁরা প্রশিক্ষণ নেবেন।
ক্ষমতায় চোখ ডিসিদের :ডিসিরা প্রতি মাসে উন্নয়ন সভার আয়োজন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তঃবিভাগের মধ্যে কোনো সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হলে এ সভার মাধ্যমে নিরসন করা হয়। প্রকল্প সম্পর্কিত কোনো তথ্য ডিসিরা আইএমইডিতে পাঠাতে পারেন না। কারণ, তাঁরা আইএমইডির জনবল নন। তাঁরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে কাজ করেন। প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠাবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আইএমইডি তথ্য সংগ্রহ করবে।
সিলেট বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজ নিজ জেলার প্রকল্প দেখভালের জন্য ডিসিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর নতুন অ্যাপ চালু করা হয়েছে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে প্রকল্প পরিদর্শনের কাজ জোরদার করতে বলেছি।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) সাধারণ সম্পাদক সমকালকে বলেন, ডিসিদের সভাপতি করে গঠন করা পরিদর্শন কমিটি বাতিল চেয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি। সম্প্রতি এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইএমইডি ও আইইবি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। এর মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারদের মাধ্যমে প্রকল্প দেখভালে চিঠি দেওয়া দুঃখজনক।
ইকোনমিক ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আইএমইডির কোন পদে কোন ধরনের লোক কাজ করবেন, এটা ঠিক করা আছে। এ জন্য সচিবকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। সংশ্নিষ্ট প্রকল্প বিষয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ করা যেতে পারে।
- বিষয় :
- আইএমইডি
- সরকারি প্রকল্প