- বাংলাদেশ
- হেলায় তৈরি গ্যাস সংকট সামলাতে বাড়ছে দাম
হেলায় তৈরি গ্যাস সংকট সামলাতে বাড়ছে দাম

কূপ খনন সম্পন্ন হয়েছে ২০১৭ সালে। প্রসেস প্লান্টও রয়েছে। শুধু কয়েক কিলোমিটার পাইপলাইন বসালেই দৈনিক প্রায় ১০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস পাওয়া যাবে। কিন্তু রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৯ নম্বর কূপের এই পাইপলাইনটুকু স্থাপনের কাজ পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছে।
রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রটি সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির। একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র। সেখানে পানি আসায় ২ ও ৩ নম্বর কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায় যথাক্রমে ২০২০ ও ২০২১ সালে। বন্ধ হওয়ার আগে কূপ দুটি থেকে দৈনিক প্রায় ৩০ এমএমসিএফ গ্যাস মিলত। এমনভাবে বন্ধ কূপ সংস্কার করলে (ওয়ার্কওভার) আবার গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো সময়ক্ষেপণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কয়েকশ গজ ব্যবধানে অবস্থিত কূপ দুটির জন্য দুটি পৃথক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দু'জন প্রকল্প পরিচালক। এতে সময় ও অর্থ দুটোরই অপচয় হবে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্নিষ্টরা। ওয়ার্কওভার হলে এ দুই কূপ থেকে দৈনিক ৩০ এমএমসিএফ থেকে ৫০ এমএমসিএফ গ্যাস মিলতে পারে, যার বাজারমূল্য ৯ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা।
দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান কার্যক্রমে স্থবিরতার পাশাপাশি এ ধরনের ছোট পদক্ষেপগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন না করায় দেশের গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। এ ছাড়া চালু কূপগুলোর উৎপাদন ধরে রাখার উদ্যোগও নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এতে বেড়েছে গ্যাসের ঘাটতি। সেই ঘাটতি মেটানো হচ্ছে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে। দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি। আগামী অর্থবছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগবে এই খাতে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আজ রোববার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। সূত্রমতে, এবার গ্যাসের দাম গড়ে ১৫-১৮ শতাংশ বাড়তে পারে।
আবাসিকে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের দাম ৩০-৪০ শতাংশ বাড়তে পারে। দুই চুলার মাসিক বিল ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ টাকা করা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা থেকে বেরিয়ে এলে, অযাজিত ব্যয়, দুর্নীতি ও গ্যাস চুরি বন্ধ করলে ভর্তুকি কিংবা মূল্যবৃদ্ধি কোনোটারই প্রয়োজন পড়ে না; বরং ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম ১৬ পয়সা কমানোর সুযোগ রয়েছে।
পরিস্থিতি সামলাতে বিশেষজ্ঞরা তেল-গ্যাসের অনুসন্ধানে জোর দিতে বলেছেন। তাঁরা বলছেন, দৈনিক পাঁচ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বাড়াতে পারলে ৬ লাখ ৫০ হাজার ডলারের গ্যাস আমদানি ঠেকানো সম্ভব। এতে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, দেশে গ্যাসের ঘাটতি বাড়বে, তা পেট্রোবাংলার হিসাবেই বলা হয়েছে। এ জন্য এলএনজির আমদানি বাড়বে, এটাও তাদের তথ্য। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংস্থাটি বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গ্যাসক্ষেত্রগুলো ব্যবস্থাপনায় নেয়নি কোনো উদ্যোগ। স্থলভাগে অনুসন্ধান নেই। সাগরে কাজই হচ্ছে না। সহসা এই সংকট কাটবে বলে মনে হয় না। কারণ, এখন একটা উদ্যোগ নিলেও তার সফলতা পেতে কয়েক বছর লাগবে।
অবশ্য পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান দাবি করেছেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান কূপ খনন ও পুরোনো কূপগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বছরখানেকের মধ্যেই এর ফল পাওয়া যাবে।
উৎপাদন কমছে অবহেলায়: গত এক বছরে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন কমেছে দৈনিক ৪০ কোটি ঘনফুট। দেশে এখন গ্যাস উৎপাদন করছে দুটি বিদেশি ও তিনটি দেশি কোম্পানি। এর মধ্যে শুধু সিলেট গ্যাসফিল্ডেই (এসজিএফএল) দৈনিক উৎপাদন ১৫ কোটি ঘনফুট থেকে কমে সাড়ে আট কোটি ঘনফুটে নেমেছে। অন্য দুটি দেশি কোম্পানির অবস্থাও একই রকম। এ বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি কূপ সংস্কার ও ব্যবস্থাপনাতেও রয়েছে অবহেলা। পেট্রোবাংলা জানত কূপগুলোর উৎপাদন কমবে। কিন্তু সংস্থাটির অবহেলা চোখে পড়ার মতো। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও রয়েছে তাদের অনীহা।
তিনি বলেন, নাইকোর সঙ্গে বিরোধ মেটার কয়েক বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনও ছাতক থেকে গ্যাস উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেই। এখান থেকে দিনে ১৫ কোটি ঘনফুট গাস মিলতে পারে।
তিন হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি: সিস্টেম লসের নামে বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৬৫ কোটি ঘনমিটার গ্যাস। এলএনজির আমদানির ব্যয় অনুসারে এ পরিমাণ গ্যাসের দাম ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিগুলোতে সিস্টেম লস দেখানো হয় ২ শতাংশের ওপরে। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে এর পরিমাণ হওয়া উচিত ০.২০ থেকে ০.৩০ শতাংশ। সিস্টেম লস বেশির হওয়ার মূল কারণ অবৈধ সংযোগ।
বাড়ছে ভর্তুকি: পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, অতিরিক্ত দামে আমদানি করায় ইউনিটপ্রতি গ্যাসে গড় খরচ হচ্ছে ২০ টাকা ৩৬ পয়সা। গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ৯ টাকা ৩৭ পয়সা। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, চলতি বছর আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ হবে সরবরাহের ২৭ শতাংশ। এতেই বছরে ভর্তুকি লাগবে ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এই ভর্তুকির টাকা সরকারের কাছে চেয়েছে সংস্থাটি।
চলতি বছর সংশোধিত বাজেটে গ্যাস খাতে ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে এলএনজির জন্য বরাদ্দ ছিল চার হাজার কোটি টাকা। যদিও এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসছে।
গত মার্চে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি-সংক্রান্ত শুনানিতে পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। সে সময় বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির পক্ষে মত দেয়।
সর্বশেষ গ্যাসের দাম বেড়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জুন। সে সময় মূল্যবৃদ্ধি করা হয় গড়ে ৩২ শতাংশ। ওই সময় দুই চুলার গ্যাসের দাম ৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা করা হয়।
বাড়বে বিদ্যুতের দামও: গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। কারণ, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫১ শতাংশ আসে গ্যাস পুড়িয়ে। গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে গত মে মাসে। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ওই শুনানিতে সেখানে পাইকারি পর্যায়ে ৬৫.৫৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিইআরসির কারিগরি কমিটি ৫৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধির পক্ষে মত দেয়।
দাম বরং কমবে: গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানায়, বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোর পুঞ্জীভূত নিট মুনাফার পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এমন মুনাফা বিইআরসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। গ্যাসের চুরি কমানো গেলে দৈনিক ৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হতো না। চুরি কমানো, উৎস ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার এবং অযাচিত ব্যয় সমন্বয় হলে ভর্তুকি কিংবা মূল্যবৃদ্ধি কোনোটারই প্রয়োজন পড়ে না; বরং দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে।
ব্যবসায়ীদেরও বিরোধিতা: গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে শিল্পোদ্যোক্তাদের মুনাফার মার্জিন কমিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানো হলে গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এতে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে। এতে সাধারণের দুর্ভোগ যেমন বাড়বে, তেমনি উদ্যোক্তারাও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে।
মন্তব্য করুন