জন্ম থেকেই কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, এমনকি সামাজিক মর্যাদায় তারা অবহেলিত। শিশু সুরক্ষার জন্য শিশু নীতিমালা, শিশু অধিকার আইন থাকলেও কন্যাশিশুদের জন্য তা কাজে আসছে না। দুর্যোগে-মহামারিতে তারা আরও বঞ্চিত হয়। অধিকার আদায়ে তাই কন্যাশিশুদের ছোট থেকে তৈরি করতে হবে। তাদের স্বপ্নকে কখনও হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। গতকাল রোববার অনলাইনে আয়োজিত 'বাংলাদেশ কন্যাশিশুর অধিকারে অগ্রগতি : কভিড-১৯-এর প্রভাব এবং করণীয়' শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এ আহ্বান জানান।

যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ ও দৈনিক সমকাল।

আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেন, আইন করে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে না। সহিংসতা প্রতিরোধে নারী-পুরুষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ছেলেদের বোঝাতে হবে, যেন তারা সাইবার বুলিংয়ের মতো কাজ না করে। মেয়েদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সবাইকে নিয়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কোয়ালিশনের সচিবালয় সহকারী সমন্বয়কারী মাইমুনা সৈয়দ আহমেদ। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে শিক্ষায় কন্যাশিশুর হার বেড়েছে। পাঠ্যক্রমে জেন্ডার বৈষম্যমূলক বেশ কিছু কনটেন্ট বাদ দেওয়া হয়েছে। আইএলও সনদ নম্বর ১৩৮ অনুমোদন করা হয়েছে। তারপরও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা এখনও বিদ্যমান। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয় কন্যাশিশুরা। এ সময় সবচেয়ে বেশি ঘটেছে শিশু ধর্ষণ।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক উইংয়ের যুগ্ম প্রধান ড. নুরুন নাহার বলেন, নারীরা ঘরের মধ্যেই শুধু নয়, বাইরেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গণপরিবহনে নিজেদের সিটে বসতে পারছেন না। পরিবারে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. শেখ মুসলিমা মুন বলেন, দুর্যোগে বেশি ক্ষতির শিকার হন নারী। কারণ, সবাইকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে, খাবারের ব্যবস্থা করে নারীকে ঘর থেকে বের হতে হয়। আশ্রয়কেন্দ্রও নারীবান্ধব নয়। সেখানে টয়লেটসহ কিছুই নারীসুলভ নয়। করোনার সময়েও নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব দেবী চন্দ বলেন, সুস্থ জাতি, সুস্থ দেশ গঠনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মাতৃত্বকালীন কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে মায়ের সেবা দেওয়া শুরু হয়।

টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডসের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাহমুদুল কবির বলেন, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের সামনে সমস্যাগুলো তুলে ধরতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে আসক পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, শুধু স্বপ্ন দেখানো নয়, নারী শিক্ষার অবারিত পথ তৈরি করতে হবে। তারা যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে, তেমন সমাজ গড়তে হবে।

কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সচিব নাসিমা আক্তার জলি বলেন, গৃহকর্মে ১১ লাখ মেয়েশিশু নিয়োজিত, যাদের অনেকেই ঠিকঠাক মজুরি পায় না। পেলেও সেটা ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে। জাতিসংঘ শ্রম আইন, বাংলাদেশের শ্রম আইন থাকলেও সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গার্লস রাইটস পরিচালক কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, নারীকে নিজেদের অধিকার আদায়ে আরও সোচ্চার হতে হবে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সমকালের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান শেখ রোকন। তিনি বলেন, শিশুর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের জন্য বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার সমকালের সম্পাদকীয় নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিশুদের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সমকাল কাজ করে যাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জেলা থেকে কন্যাশিশু ফাতেমা আক্তার, মোহসিনা আক্তার, শিরীন আক্তার, মাহফুজা জাহান মুন্নী, রুবাইয়া সুলতানা দিবা, সুরমি, আদুরী বাস্কে, রওনক সামিয়া ও নিওমা চৌধুরী অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী কিশোরীরা বলে, বর্তমান সমাজে বাল্যবিয়ে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার অভাবে এটি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিয়ের প্রথম কারণ দরিদ্রতা। তারা আরও বলে, রাষ্ট্র সব মেয়ের শিক্ষা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাষ্ট্রকেই সব মেয়ের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ১০টি সংগঠনের একটি জোট। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ কোয়ালিশনের সচিবালয় হিসেবে কাজ করছে। সদস্য অন্য সংগঠনগুলো হলো- একশনএইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যাসেমব্লি, এডুকো বাংলাদেশ, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ, টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।

বিষয় : 'কন্যাশিশু চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন সমকাল জাতীয় সংলাপ

মন্তব্য করুন