আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে রাজনৈতিক সমঝোতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন একাধিক সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তাঁদের মতে, ভোট গ্রহণ ও গণনার কাজ সন্ধ্যার আগেই শেষ করতে হবে। সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের আগেই পদত্যাগ, ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা ডাকাত সরাতে না পারলে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। কমিশনের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় এমন বক্তব্য উঠে আসে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় সাবেক কমিশন সদস্য ছাড়াও নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের একাধিক সাবেক সচিব ও সাবেক ইসি কর্মকর্তারা অংশ নেন। সভায় সাবেক সিইসি, ইসি ও ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ ২৮ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০ জন অংশ নেন।

তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা, সাবেক সিইসি শামসুল হুদা, সাবেক সিইসি বিচারপতি আব্দুর রউফ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ও মো. আবু হাফিজ, সাবেক ইসি সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব বেগম জেসমিন টুলী।

নির্বাচনে সেনাবাহিনী কোনো কাজে আসে না: কে এম নূরুল হুদা নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার পরামর্শ দিয়েছেন সদ্য বিদায়ী সিইসি কে এম নূরুল হুদা। তাঁর মতে, বাংলাদেশের নির্বাচনে যে সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়, এটা বিশ্বে বিরল। হাজার হাজার লোক বন্দুক হাতে যুদ্ধাবস্থার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনী মোতায়েন একেবারেই দরকার নেই। কারণ, বিগত নির্বাচনে তাদের অ্যাক্টিভিটিজ দেখেছি। নির্বাচন পরিচালনার কোনো কাজে তারা আসে বলে আমার মনে হয় না। সুতরাং এই এলিট ফোর্স সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের সময় মাঠে নামানোর কোনো দরকার নেই।'

নির্বাচনী খরচের ৭৫ ভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় হয়- এমন দাবি করে তিনি বলেন, 'একটা কেন্দ্রে যে পরিমাণ সশস্ত্র সদস্য থাকে, তা একটা থানার সমান। এখন তো আমাদের সেই পরিস্থিতি নেই যে বাক্স আছে, লোকজন ব্যালটে ভোট দেবে। এখন এ জন্য আছে ইভিএম। ইভিএম এমন একটা বিষয়, যেখানে বাক্স ছিনতাই করা যায় না। একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না। নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে ইভিএম চালু করা যায় না।'

অংশগ্রহণমূলক ছাড়া গ্রহণযোগ্য হবে না: শামসুল হুদা

ওয়ান-ইলেভেনের আমলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, 'এবারের নির্বাচনে সব দল যদি না আসে, তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং কীভাবে আনবেন বা আপনারা কী অফার করবেন, তার ওপর নির্ভর করবে। আমার সময়ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ওয়াজ প্রবলেমেটিক (সমস্যা ছিল)। তাদের আনতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এখন তাঁরা যেসব কথাবার্তা বলছেন তাতে তো মনে হয়, তাঁরা নির্বাচনে যেতে রাজি নন।'

সাবেক এই সিইসি তাঁর আমলে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, এনআইডি উইং এখন সরকারের বিভিন্ন দপ্তর তাঁদের আওতায় নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। তিনি এ তৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানান।

সাবেক এই সিইসি ডিসিদের পরিবর্তে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার পরামর্শ দেন। সব জায়গায় উপযুক্ত লোকবল নেই, প্রশিক্ষিত লোকবল দরকার। সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইসি কর্মকর্তাদের নিয়োগ একেবারে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না।

সন্ধ্যার পরে ভোট গণনায় জিন-ভূতের আসর: আব্দুর রউফ

১৯৯০ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের আমলে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সিইসি বিচারপতি আব্দুর রউফ দিনের মধ্যে ভোট গণনা শেষ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, পরিবর্তন করতে না পারলেও প্রতি ৫০০ জনের জন্য একটি পোলিং স্টেশন তৈরি করেন। এতে ভোটের সময় কমে যাবে; ৮টা থেকে ১২টার মধ্যে ভোট শেষ হবে। দিনে দিনে ভোট গণনা শেষ করতে পারবেন। তিনি বলেন, যে জিনিসটা সবচেয়ে খারাপ তা হলো ভোট গণনার সময় শুরু হয় সন্ধ্যার পর। সন্ধ্যার পর জিন-ভূত যা কিছু আছে সব দেখা যায়। বাতি নিভতে শুরু করলে শুরু হয় তাদের আনাগোনা।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চান মাহবুব তালুকদার

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্র্পণালয়কে ইসির কাছে ন্যস্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে একটাই চ্যালেঞ্জ; আর তা হচ্ছে- সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার। গ্রহণযোগ্য সরকারই কেবল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংসদ সদস্যদের পদে বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণা বাতুলতা মাত্র। নির্বাচনের আগে সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ না করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, পুলিশের কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটর করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে ইসির সঙ্গে সরকারের সংলাপ অনিবার্য। তার রূপরেখা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজনের কথাও উল্লেখ করে তিনি জানান, সংবিধান সংশোধন না হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করা যাবে না।

সাবেক কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, 'নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ দেখতে হবে। খুবই কঠোর হতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ইনভল্‌ভ হওয়া যাবে না। এটা সরকারি দলের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। আইন প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে হবে। তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা কাজী রকিব কমিশনের এ সদস্য আরও বলেন, 'আমাদের সময় যারা নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাদের আনার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়নি। অনেক সহিংসতা হয়েছে। ওই সময় নির্বাচন না হলে সহিংসতা আরও হতো।' তিনি বলেন, যারা সরকারি দল, তারা চিন্তা করবে অন্য দলগুলোকে কীভাবে নির্বাচনে আনা যায়।

সাবেক কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, ইভিএমের ভোটে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা ডাকাত সরাতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।

সাবেক ইসি সচিব মো. আবদুল্লাহ সব দল এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে বলেন, যে কোনো মূল্যে সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এটি সম্ভব হলে ইসির ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। মাঠে যদি সব দল থাকে; অনিয়ম কম হবে। কারণ কেউ অনিয়ম করতে গেলে অন্যরা বাধা দেবে। আর তাতে অনিয়ম ঠেকাতে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরই একমাত্র দায়িত্ব হবে না। প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা যাঁর যাঁর কেন্দ্রে তাঁরা নিরাপত্তা দেবেন।

বিদ্যমান পদ্ধতিতে খুব বেশি ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়: সিইসি

মতবিনিময় সভার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সাবেক সিইসিদের মতে, বিদ্যমান পদ্ধতিতে খুব বেশি ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, ঐকমত্য না থাকলে ইসির পক্ষে নির্বাচন করা কষ্টকর হবে। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তবে কমিশন যদি দৃঢ় থাকে; আইন দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে অনেকটা উন্নয়ন সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সিইসি বলেন, 'সাবেক সিইসি আব্দুর রউফ প্রার্থী অনুযায়ী নয়; দলভিত্তিক নির্বাচনের কথা বলেছেন। নির্বাচনে দেখা গেল, অনেক আগে থেকে দলগুলো তাদের টোটাল প্রার্থীর নাম দিয়ে যাবে। সবাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দিল। পার্টি ক, খ, গ, ঘ। যে যত ভোট পেয়েছে, সেভাবে আসন পাবে। এ ধরনের একটা সিস্টেম আছে। তবে এটা আমাদের বিষয় নয়। দলগুলোকেই দেখতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, বর্তমান ইসি শপথ নিয়েছে বর্তমান আইনি কাঠামোতে। বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই ইসিকে নির্বাচন করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, একাধিক দিনে নির্বাচন করলে আইনশৃঙ্খলা মোতায়েন সহজ হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। কেউ কেউ বলেছেন, এতে সমস্যাও হবে। এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। কাজেই একাধিক দিনে নির্বাচন করলে অসুবিধাও হতে পারে। ওই ধরনের প্রস্তুতি ইসির নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সবাই বলেছেন- নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নির্বাচন যদি ইনক্লুসিভ না হয়; নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাস্তব অর্থে থাকবে না। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। এই কালচারের মধ্যে কিছু ইতিবাচক গুণ আনতে হবে। তাদের মধ্যে পরমতসহিষুষ্ণতা, ঐকমত্য যদি না থাকে; নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে খুব ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, ঐকমত্য না থাকলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করা কষ্টকর হবে- এটা আমাদের ও অতিথিদের বক্তব্য।

সহসাই রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের কথা জানিয়ে সিইসি আউয়াল বলেন, তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হবে। ব্যক্তি নয়; সিস্টেম যদি উন্নত করতে পারি; নির্বাচন অনেক বেশি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে।