- বাংলাদেশ
- আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রশ্ন তুলতে পারে
পাচার হওয়া অর্থের বৈধতা দান
আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রশ্ন তুলতে পারে

প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। সরকারের এ ঘোষণার পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। এক পক্ষ বলছেন, সরকারের এ ঘোষণা যদি কার্যকর করা হয়, তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একজন অপরাধ করলে বিচার হবে, আর অন্যজন করলে নিস্কৃতি পাবেন- এটা হতে পারে না। সরকারের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারাধীন মানি লন্ডারিং মামলা চলবে কিনা, তা নিয়ে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে।
অন্যপক্ষ বলছেন, সরকারের এ ঘোষণার সঙ্গে বিচারাধীন মামলার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অভিযোগ ও তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা করা হয়েছে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বিচারে কোনো বাধা হবে না। এদিকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কিংবা কর ফাঁকির মাধ্যমে উপার্জিত বাইরে নেওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। যে কারণে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিএফআইইউর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অর্থ বিলে বলা হয়েছে, কর ফাঁকি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাইরে নেওয়া যে অর্থের বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা চলমান আছে, তা এ সুযোগের আওতায় পড়বে না। এর মধ্যে একটা ফাঁক রাখা হয়েছে। এর মানে, যে ক্ষেত্রে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তাঁরা বিদেশে থাকা সম্পত্তি কর প্রদানের মাধ্যমে বৈধ করতে পারবেন।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিভিন্ন সময়ে কিছু দেশ পাচার অর্থ এভাবে ফেরত আনছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়েছে। ফলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সম্পৃক্ত আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার প্রশ্নের মুখে পড়লে সরকারকে পরিস্থিতি তুলে ধরতে হবে।
গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে। আর বিদেশে অবস্থিত স্থাবর সম্পত্তি দেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি দেশে না আনলে এই সম্পদের মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিলে এর উৎস সম্পর্কে সরকারের কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না। আগামী ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকবে। সরকারের এই ঘোষণার পর সিপিডি, টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং রাজনৈতিক দল একে বেআইনি ও অনৈতিক আখ্যা দিয়েছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, পাচার হওয়া অর্থ সাদা করার সুযোগ সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এর অর্থ, একটা অপরাধকে বৈধতা দিতে আরেকটি অপরাধ সংঘটনে উৎসাহ দেওয়া। এ ধরনের অপরাধ করার সুযোগ দেওয়া হলে ভবিষ্যতে অনেকেই বিদেশে টাকা পাচারের সুযোগ পাবেন। অপরাধের প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারের এই দ্বিমুখী নীতির কারণে আদালতে বিচারাধীন মানি লন্ডারিং মামলাগুলো আর সচল থাকবে না। এতে বিচার বাধাগ্রস্ত হবে এবং মামলা দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিশিস্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, সরকারের এ ঘোষণায় আইনের নৈতিক ভিত্তি অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেল। একই অপরাধে একজনের শাস্তি হবে অন্যজনের হবে না- এখানেই প্রশ্ন থেকে গেল। এতে করে আইনের নৈতিকতা থাকল না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এতে করে বিচারাধীন মানি লন্ডারিং মামলার ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, সরকারের এই ঘোষণায় একটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধানে বলা আছে, আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু সরকার এটি লঙ্ঘন করেছে। কাউকে সুযোগ দেবে, আর কাউকে দেবে না- এটি সাংঘর্ষিক ও সরকারের দ্বিমুখী আচরণ। তিনি সমকালকে বলেন, পাচারের অভিযোগে করা মামলার বৈধতা নিয়ে রিট করা হলে আদালতে অবশ্যই তিনি রিলিফ পাবেন। সেক্ষেত্রে আদালতে বিচারাধীন মানি লন্ডারিং মামলা আর চলবে না, বিচার অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, 'একই দেশে দুই রকম আইন চলতে পারে না। আমি অতীতে অপরাধ করেছি বলেই সাজা হবে, আর আপনি বর্তমানে অপরাধ করেছেন বিধায় পুরস্কার পাবেন- এটা তো আইনের দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক।'
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন সমকালকে বলেন, যাঁরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বর্তমান সময়ে পাচার করা টাকা ফেরত নিয়ে আসবেন, তাঁরাই শুধু এই সুযোগ পাবেন। আর যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তদন্তের ভিত্তিতে মানি লন্ডারিং মামলা হয়েছে, তাঁদের জন্য এ সুযোগ নয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান মনে করেন, পাচার হওয়া অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে বিচারাধীন মানি লন্ডারিং মামলার বিচারে কোনো বাধা হবে না। কারণ হিসেবে তিনি সমকালকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। এটা এখনও আইনে পরিণত হয়নি। এ ঘোষণার সঙ্গে বিচারাধীন মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, এ ঘোষণা সরকারের একটা নীতি, তবে এটা অপরিপকস্ফ সিদ্ধান্ত। আইন পাসের আগে সরকারকে স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়নের পর বিভিন্ন সময়ে দায়ের হওয়া ৫ শতাধিক মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে আলোচিত মামলার সংখ্যাও কম নয়। এর বাইরে কিছু মামলা তদন্ত করছে দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা। আইনের ফাঁকফোকর ও নানা অজুহাতে এসব মামলা বিচারের বিলম্ব দেখানো হচ্ছে। মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির পরিমাণ অনেক কম।
মন্তব্য করুন