- বাংলাদেশ
- বিনা খরচে কর্মী পাঠানোর সুযোগ 'সিন্ডিকেটে' আটকা
বিনা খরচে কর্মী পাঠানোর সুযোগ 'সিন্ডিকেটে' আটকা

ছবি: ফাইল
শুধু নিজের টাকায় পাসপোর্ট করতে হবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিমান ভাড়াসহ বাকি সব খরচ নিয়োগকারীর। বিদেশি শ্রমিক সংকটে ধুঁকতে থাকা মালয়েশিয়া থেকে এমন আকর্ষণীয় চাহিদাপত্র এলেও বাংলাদেশি কর্মীরা নিয়োগের অনুমতি পাচ্ছেন না 'সিন্ডিকেটের' বাধায়।
মালয়েশিয়াতেও সিন্ডিকেটের পক্ষে-বিপক্ষে টানাপোড়েন চলছে। দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানানসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আমলা সিন্ডিকেটের পক্ষে থাকলেও মালয়েশীয় নিয়োগকারীরা এর বিরুদ্ধে। দেশটির সরকার এখনও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ অনুমোদন করেনি। এম সারাভানানের সমালোচনায় মুখর সরকারদলীয় এমপিরাও।
মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীনদের একাংশ যে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের পক্ষে, তাতে বাংলাদেশের এক মন্ত্রীর স্ত্রী ও তিন এমপির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিন্ডিকেট কাজ পাবে কি পাবে না, এ টানাপোড়েনে অন্য এজেন্সিগুলোও কর্মী পাঠাতে পারছে না। মালয় নিয়োগকারীর চাহিদাপত্র বাংলাদেশ হাইকমিশন সত্যায়িত করে পাঠালেও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়োগানুমতি দিচ্ছে না। সূত্র জানায়, চাহিদাপত্র সত্যায়িত না করতে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক এজেন্সি মালিকদের চাপ রয়েছে।
রয়্যাল পাহাং ডুরিয়ান প্রোডিউস সিএনডি বিএইচডি নামে মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান ৩২৫ জন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে তিনটি পৃথক চাহিদাপত্র দিয়েছে। এর কপি সমকালের কাছে রয়েছে। বাংলাদেশি এজেন্সি সিমপ্লেক্স ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগে মালয় সরকারের সব সংস্থার অনুমতিও রয়েছে। ৮ জুন চাহিদাপত্র সত্যায়িত করেছে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন।
সিমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা অংশীদার আবু বক্কর সমকালকে জানান, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগানুমতির আবেদন করেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করে বলছে না, নিয়োগানুমতি দেওয়া হবে কি হবে না। তিনটি চাহিদাপত্রে ৭০, ৫৫ ও ২০০ জন কর্মীর চাহিদাপত্র এসেছে। সরকারি সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ডাটাবেজে নিবন্ধিতদের মধ্য থেকে বাছাই করে কর্মী পাঠাতে হবে। বাছাইয়ের পর মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। এরপর ভিসা পেলে কর্মী যাবে মালয়েশিয়ায়; কিন্তু নিয়োগানুমতি না পাওয়ায় আটকে আছে।
আবু বক্কর জানান, পাসপোর্ট ও সরকারি ফি বাবদ কর্মীর হাজার দশেক টাকা লাগবে। এজেন্সিকেও টাকা দিতে হবে না। কর্মীর এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার এজেন্সিকে সার্ভিস চার্জ বাবদ দেবে নিয়োগকারী।
নিয়োগানুমতির বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন সমকালকে বলেছেন, চাহিদাপত্রগুলো পেয়েছেন। মালয়েশিয়া কী প্রক্রিয়ায় কলিং ভিসা দেবে, তা জানার পর আজ রোববার নিয়োগানুমতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
মালয় মানবসম্পদমন্ত্রী বারবার অবস্থান বদল করায় মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলে সূত্র জানিয়েছে। সারাভানান ঢাকায় এসে বলেছেন, মালয় সরকারের অনুমোদন রয়েছে ২৫ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগে। কিন্তু দেশে ফিরে বলেন, বাংলাদেশ সম্মতি দিয়েছে সীমিত সংখ্যক এজেন্সির বিষয়ে।
মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, তাঁদের সন্দেহ বাংলাদেশ থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগে পদ্ধতি চালু করতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। সিন্ডিকেট কাজ পেলে ২৫ এজেন্সিই কর্মী পাঠাবে। ফলে অন্য এজেন্সির চাহিদাপত্রে নিয়োগানুমতি দিলে কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ জানিয়েছিলেন, জুনেই কর্মী যাবে। তবে জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেছেন, সিন্ডিকেটের পক্ষে-বিপক্ষে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে হয়তো শ্রমবাজার খুলবে না। এদিকে, মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে বিএমইটি। হাজারো কর্মী নিবন্ধিত হয়েছেন গত পাঁচ দিনে।
কৃষি খাতে ৭০ জন পুরুষ কর্মী চেয়ে গত ১০ মে সিমপ্লেক্সকে চাহিদাপত্র দেয় রয়্যাল পাহাং ডুরিয়ান প্রোডিউস। চাহিদাপত্র অনুযায়ী, ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী কর্মী তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। ২৮১ রিঙ্গিত ওভারটাইম ভাতাসহ মাসে সাকল্যে বেতন ১ হাজার ৭৮১ রিঙ্গিত (প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা)। মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিটের লেভিও দেবে নিয়োগকারী। আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া, দুই দেশে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বীমার প্রিমিয়াম, ছাঁটাই করলে ক্ষতিপূরণসহ সব সুবিধা দিতে হবে কর্মীকে।
জনশক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, মালয়েশিয়ায় বিনা খরচে কর্মী পাঠানোর সুযোগ এই প্রথম এসেছে। চাহিদাপত্রের শর্ত পালনে গত ১২ মে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে অঙ্গীকারনামা দিয়েছে রয়্যাল পাহাং ডুরিয়ান প্রোডিউস।
হাইকমিশনের শ্রম উইংয়ের মিনিস্টার নাজমুস সাদাত সেলিম সমকালকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইমিগ্রেশন বিভাগের অনুমোদিত চাহিদাপত্র যাচাই করে ৮ জুন সত্যায়িত করা হয়েছে। আরও অনেক চাহিদাপত্র এসেছে।
মালয়েশিয়া সরকারকে ১ হাজার ৫২০টি এজেন্সির তালিকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে নাজমুস সাদাত বলেছেন, বাংলাদেশ ২৫ বা কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক এজেন্সির প্রস্তাব দেয়নি। মালয় সরকারের অনুমোদিত চাহিদাপত্র যে এজেন্সির নামেই আসুক, নিয়োগকারীর চাকরি ও বেতন দেওয়ার সক্ষমতা থাকলে সত্যায়িত করবে হাইকমিশন।
বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক সই করে মালয়েশিয়া। গত জানুয়ারির চিঠিতে মালয়েশিয়ার মন্ত্রী জানান, ২৫ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেবে তাঁর দেশ। জবাবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের আইনে সীমিত সংখ্যক এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর সুযোগ নেই।
যদিও সমঝোতা স্মারকেই এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মালয়েশিয়াকে। আরও ১৩ দেশের সঙ্গে কর্মী নিয়োগে চুক্তি রয়েছে মালয়েশিয়ার। তাতে এমন শর্ত নেই। গত ২ জুন জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ রাজি হয়, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী মালয়েশিয়া এজেন্সি বাছাই করবে। যদিও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেছেন, এজেন্সির সংখ্যা বাংলাদেশ নির্ধারণ করেনি।
২০১৫ সালের সমঝোতা স্মারকে (জিটুজি প্লাস) ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। প্রায় তিন বছরে পৌনে তিন লাখ কর্মী নিয়োগে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে- এ অভিযোগে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় ফিরে মাহাথির মোহাম্মদ সরকার জিটুজি প্লাস বাতিল করে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে। এবার বিনা খরচে কর্মী পাঠানোর সুযোগ এলেও জিটুজি প্লাসে কর্মীপ্রতি নির্ধারিত ব্যয়ের ৮-১০ গুণ টাকা আদায় করেছিল সিন্ডিকেট। আবারও দুর্নীতির অভিযোগে বাতিল হওয়া পদ্ধতিতেই কর্মী নিতে চাইছে মালয়েশিয়া।
সিন্ডিকেটের সমর্থক জনশক্তি ব্যবসায়ী ফেনী-৩ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, সোমবার নাগাদ এজেন্সি তালিকা মালয়েশিয়া চূড়ান্ত করতে পারে।
সিন্ডিকেট হলে অন্য এজেন্সিগুলো কী করে চাহিদাপত্র পাচ্ছে- এমন প্রশ্নে মাসুদ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ ১৪টি সোর্স কান্ট্রির একটি। চাহিদাপত্র দিতে বাধা নেই। এজেন্সির সংখ্যা নির্ধারিত হলে শুধু তালিকাভুক্তদের মাধ্যমে চাহিদাপত্র আসবে।
সিন্ডিকেটবিরোধী জনশক্তি ব্যবসায়ীদের নেতা শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেছেন, মালয়েশিয়ায় ৮-১০ লাখ বিদেশি শ্রমিকের সংকট রয়েছে। নিয়োগকারীরা মালয় সরকারকে জানিয়েছে, বিলিয়ন ডলার লোকসান হচ্ছে কর্মী সংকটে। চাহিদাপত্র এলে নিয়োগানুমতি না দেওয়ার প্রসঙ্গে শামীম আহমেদ বলেছেন, কর্মীর ভিসা মালয় সরকার ও নিয়োগকারীর বিষয়। কাজ আছে, তা নিশ্চিত হয়ে হাইকমিশন চাহিদাপত্র সত্যায়িত করেছে। ভালো বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। সিন্ডিকেটের কারণে এ সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। সব এজেন্সিকে কাজ দিলে ছয় মাসে পাঁচ লাখ কর্মী পাঠানো সম্ভব। ২৫ এজেন্সি যা পারবে না।
মন্তব্য করুন