- বাংলাদেশ
- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি
জন্মদিনে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি

বুদ্ধিজীবী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ঔপনিবেশিক, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ- ইতিহাসের তিনটি পর্যায়ে আমার যোগাযোগ ঘটেছে। এই সময়ে বড় রাষ্ট্র ছোট থেকে আরও ছোট হলো। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রাষ্ট্রের কাঠামো আমলাতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক বিকাশ পুঁজিবাদী হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘ বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক তাঁর জীবনের নানা অংশে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানা ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনও উপনিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরও ইংরেজিতে বক্তৃতা করতাম, এখনও এটি রয়ে গেছে। রাষ্ট্র বদল হলেও উপনিবেশ বদল হয়নি। পাকিস্তানিরা পূর্ববঙ্গকে একটি উপনিবেশ করতে চেয়েছিল। আজ বাংলাদেশ উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এটি পশ্চিমা উপনিবেশ নয়, এটি বাঙালি বেনিয়াদের উপনিবেশ, যারা বিদেশে টাকা পাচার করে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৪৩ সালে ৩০ লাখ লোক মারা গেল। আমাদের গ্রামে একজন আত্মহত্যা করেছে। আমরা তখন শিশু। গিয়ে দেখলাম, লোকটি গাছে ঝুলছে। তিনি বেকার এবং অনাহারে ভুগছিলেন। এই আত্মহত্যার ঘটনা আমাকে ব্রিটিশ আমলের কথা মনে করিয়ে দেয়। ব্রিটিশ শাসনের একটি প্রতিচ্ছবি ছিল এ ঘটনা।
পাকিস্তান রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মতো এত বড় দুর্ঘটনা আমাদের ইতিহাসে আর ঘটেনি। পলাশী হলো প্রথম দুর্ঘটনা এবং দেশভাগ হলো দ্বিতীয় দুর্ঘটনা। '৪৭ সালে আমরা এসে স্টেশনে নামলাম। ঢাকায় আমাদের কোনো থাকার জায়গা ছিল না। বহু আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে নাজিরাবাজার উঠলাম। একটি বিষয় দেখলাম, যাঁরা সরকারি চাকরি করতেন, তাঁরা অবসর নিয়ে এসেছেন। কিন্তু যাঁরা বেসরকারি চাকরি করতেন, ছোটখাটো ব্যবসা করতেন, তাঁরা বেকার হয়ে গেছেন। পাকিস্তানিরা গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে এলে, কারও মুখে কোনো আনন্দ ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটিই আমার পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা।
তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরে সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের মেয়ে ও তাঁর মায়েরা বাইরে বের হলে রিকশা কাপড় দিয়ে ঘিরে বের হতেন। কিন্তু বোরকা পরে মেয়েরা রাস্তাঘাটে এখন যেমন চলাফেরা করছে, এমন আমরা দেখিনি। এখন হিজাব, বোরকা কীভাবে এলো আপনারা দেখেছেন। প্রতিদিন সকালে উঠে একটি টিপ পরতেন, সেটি নিয়ে মা মেয়েদের বকাঝকা করতেন। বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি, টিপ পরার কারণে পুলিশের লোক মোটরসাইকেল দিয়ে মেরে ফেলতে উদ্ধত হয়েছিল। এসব পরিবর্তন আমাদের সামনেই ঘটল, এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের ছবি।
তিনি বলেন, আরেকটি সত্য হলো- '৪৭ সালে আমরা যখন স্বাধীন হলাম, রেশন কার্ড ছিল একটি জরুরি ব্যবস্থা। খাবারের জন্য পচা চাল, দুর্গন্ধ গম কলে ভাঙাতে হতো। আবার যখন '৭১-এ স্বাধীন হলো, তখন দুর্ভিক্ষ; তেল পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুর অভাব। এভাবেই পরিবর্তন আমরা দেখলাম।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি ওসমানী উদ্যান রক্ষা, লালনের আখড়া, আড়িয়ল বিল রক্ষা- এই তিনটি আন্দোলনে ছিলাম। এটি পরিবেশের কারণে নয়, অধিকারের জায়গা থেকে আমি আন্দোলন করেছি। ওসমানী উদ্যান আমাদের খোলা জায়গা; সেটি কেন একটি অডিটোরিয়াম নির্মাণের জন্য নেওয়া হবে, আড়িয়ল বিলে কেন বিমানবন্দর হবে, তাও অবৈজ্ঞানিকভাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও কেন দায়িত্ব নেননি- ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এরশাদের সময় আমাকে উপাচার্য হতে হবে, এই ভয় আমি পেয়েছিলাম। তারপর আমাদের ইলেকট্রিশিয়ান এসে আমার স্ত্রীকে বলল, আপা, স্যার নাকি ভিসি হবে, তাহলে তো আমাদের কপাল খুলে যাবে। আমি এও ভাবলাম, এদের আশা তো আমি মেটাতে পারব না। এমন বহু লোক আসছে দেখা করতে, তাঁদের সবার আগ্রহ আমি মেটাতে পারব না। ডিন হয়ে আমি বুঝেছি, এসব আমার কাজ নয়। স্ত্রীর মধ্যেও ভয় ঢুকেছিল- বড় বাড়িতে গেলে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফেরত এলে আমাদের কীভাবে তাঁরা গ্রহণ করবে। আমি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে ছোট করে সে বলেছিল, আমি কিন্তু একজন লেকচারারকে বিয়ে করেছিলাম। এর পরই বুঝেছি, উপাচার্য আমার পথ নয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অনুষ্ঠানের শুরুতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চারণ এবং বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা। এরপর বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ফুলেল শুভেচ্ছা প্রদান করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও সহযোগী সম্পাদক সবুজ ইউনুস, কবি মোহাম্মদ সাদেক, আন্দালীব রাশদী প্রমুখ। এছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ২১টি সাক্ষাৎকার নিয়ে 'আজ ও আগামীকাল' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। চারণ, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গান পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করে শোনান অধ্যাপক আজফার চৌধুরী।
মন্তব্য করুন