
সিলেটের ওসমানী নগরের মোতিয়ারগাঁও থেকে ছবিটি তুলেছেন ইউসুফ আলী
শিক্ষা খাতে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার মধ্যেই এবারের বন্যা ডুবিয়ে দিয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও। সিলেট বিভাগের এবং দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অনেক জেলাসহ মোট ১২টি জেলায় বন্যায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন স্তরের অন্তত এক কোটি শিক্ষার্থীর। দরিদ্র কয়েকশ ছাত্রছাত্রীর বই-খাতা ভেসে গেছে; ডুবে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। প্লাবিত হয়েছে, এমনকি পুরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে বহু একতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্যমতে, অন্তত তিন হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। আবার দ্বিতল-ত্রিতল ভবনবিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থাপিত হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানেরও শিক্ষা কার্যক্রম এখন সম্পূর্ণ বন্ধ।
বন্যার কারণে এরই মধ্যে স্থগিত হয়ে গেছে ২০২২ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ১৯ জুন থেকে সারাদেশে একযোগে এই পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষাও।
জানা গেছে, বন্যাদুর্গত এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার মাঠ পর্যায়ের চিত্র শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত অধিদপ্তরকে জানাচ্ছেন। তাঁদের পাঠানো তথ্যমতে, সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ভাঙনের ক্ষত রেখে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানিয়েছেন, সংস্কার না করে এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। জানা যায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের অন্তত ১ হাজার ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এরই মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা চূড়ান্ত করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে ২১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারসহ নানা কারণে ২৮টি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, শান্তিগঞ্জসহ জেলার পাঁচটি উপজেলার ২১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিমজ্জিত হয়েছে। ছাতকে ১৭২, দোয়ারাবাজারে ২৩, সদর উপজেলার ২০ ও শান্তিগঞ্জের একটিসহ ২১৬টি স্কুলে পানি ঢুকে ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুর রহমান সমকালকে বলেন, এবারের বন্যায় স্কুলের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতিসহ পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফীউল্লাহ ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম মণ্ডল জানান, বন্যার কারণে সিরাজগঞ্জ জেলার নদীতীরবর্তী ও নিচু এলাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলে ৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
গত ১৯ জুন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আদেশ জারি করে, বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বন্যাপ্রবণ এলাকায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। দেশের জলমগ্ন সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শ্রেণি পাঠদান স্থগিত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
বিপর্যয়কর অবস্থা সিলেটে :মাউশির মনিটরিং ও ইভালুয়েশন উইংয়ের উপপরিচালক সেলিনা জামান সমকালকে জানান, আগামী সোমবার সারাদেশের বন্যাকবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও ক্ষতির তালিকা তাঁরা প্রকাশ করবেন।
তবে বিপর্যয়কর তথ্য পাওয়া গেছে সিলেট থেকে। গতকাল বৃহস্পতিবার মাউশির সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক অফিস থেকে মাউশির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো তথ্যে বলা হয়, এ মুহূর্তে সিলেট বিভাগে পাঠদান উপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৫০টি। আংশিক পাঠদান উপযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও কম, ৪৬টি।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা নিয়ে গঠিত সিলেট বিভাগ। এর মধ্যে সিলেটে বন্যাকবলিত উপজেলার সংখ্যা ১৩টি, সুনামগঞ্জে ১১, মৌলভীবাজারের ৫ ও হবিগঞ্জে ৬টি। সিলেট জেলার ৩১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যা কবলিত। এর মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে ১৭৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিলেট বিভাগের যে ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনই পাঠদান সম্ভব, তার সব ক'টিই সিলেট জেলার। এই জেলায় এখনও ১ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বন্যাকবলিত।
সুনামগঞ্জে ২৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত। এ ছাড়াও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে আরও ১১৮টি স্কুল-কলেজ। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পাঠদান সম্ভব নয় বলে জানায় সুনামগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিস। এই জেলার প্রায় দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থী বন্যাকবলিত।
মৌলভীবাজারের ৩৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত। ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এই জেলার প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী বন্যার পানিতে আক্রান্ত। হবিগঞ্জে ২৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যায় আক্রান্ত। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৫৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই জেলায় বন্যায় কবলিত ২৭ হাজার শিক্ষার্থী।
বিঘ্নিত এসএসসি-এইচএসসিসহ নানা পরীক্ষা :বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে স্থগিত হয়ে গেছে বিভিন্ন ধরনের একাডেমিক ও নিয়োগ পরীক্ষাও। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলমান ২০২০ সালের বি.এড অনার্স প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টার এবং বি.এড অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিত হয়ে গেছে এসএসসির মতো বড় পাবলিক পরীক্ষাও।
কয়েক বছর ধরেই ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি আর এপ্রিল মাসে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হতো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হতো ফলাফল। এই ধারায় বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমে একটি নিয়মিত রুটিনও চালু হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ছেদ পড়ে এই কার্যক্রমে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষা ঈদের পর শুরু হবে বলে সমকালকে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক। তিনি বলেন, সার্বিক বন্যার কারণে ঈদের আগে পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। ঈদের পর পরীক্ষা নিতে হবে। আর এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার কারণে এইচএসসি পরীক্ষাও পিছিয়ে যাবে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সমকালকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রুটিন প্রকাশ করা হবে। নতুন রুটিনে পরীক্ষা শুরু করে দেব। সিলেট থেকে পানি নামা শুরু করলেও নতুন নতুন জেলা প্লাবিত হচ্ছে। কবে নাগাদ বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা স্পষ্ট নয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে রুটিন প্রকাশ করা হবে।
অধ্যাপক তপন কুমার বলেন, এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করতে দুই মাস সময় প্রয়োজন হয়। সে কারণে এইচএসসি পরীক্ষাও পিছিয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন