- বাংলাদেশ
- ট্রেনের টিকিটের জন্য রাতদিন স্টেশনে
কিশোরী-তরুণীদের কষ্ট
ট্রেনের টিকিটের জন্য রাতদিন স্টেশনে

ছবি: ফাইল
দিনাজপুরের মেয়ে সানজিদা রাইমা সেতু রাজধানী মিরপুরের বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ঢাকায় থাকেন হোস্টেলে। ঈদে বাড়ি যাবেন। বাসের টিকিট পাননি। শেষ ভরসা ট্রেন। গতকাল রোববার দুপুর ২টায় তিনি আসেন কমলাপুরে। কোথায় টিকিট মিলবে- জানতে রেলকর্মীদের পেছনে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছিলেন তিনি।
পরে টিকিটপ্রত্যাশী অন্য যাত্রীদের কাছে জানতে পারেন, ৮ জুলাইয়ের টিকিট দেওয়া শুরু হবে আরও ১৮ ঘণ্টা পর সোমবার সকাল ৮টায়। টিকিট পেতে এখনই সিরিয়ালে নাম লিখিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে। তারপরও পাওয়া যাবে কিনা অনিশ্চিত। টিকিট লাগবেই- তাই রাতভর স্টেশনে দাঁড়িয়ে বসে থাকতে হবে জেনেও লাইনে দাঁড়িয়ে যান সেতু।
কমলাপুর স্টেশনের ১০টি কাউন্টারে রংপুরের আট জেলা এবং বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। ১৮ নম্বর কাউন্টার নারীদের জন্য সংরক্ষিত। যাত্রীরা নিজেরাই নাম লিখে লাইনে সিরিয়াল দাঁড়াচ্ছেন। সিরিয়াল রক্ষার কাজটি করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি যাবেন রংপুরে।
লালমনি বা রংপুর এক্সপ্রেসের টিকিটের জন্য শনিবার রাত ৮টায় স্টেশনে আসেন জান্নাত। রাত কাটিয়েছেন এখানেই। ছেলেরা শুয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করলেও মেয়েদের জন্য স্টেশনের খোলা চত্বরে শুয়ে থাকা অস্বস্তির। আব্রু রক্ষাও কঠিন। তাই কাউন্টারের ব্যারিয়ারে হেলান দিয়ে রাত পার করেন জান্নাত। এত কষ্ট কাজে আসেনি। রোববার সকালে টিকিট পাননি। তিনি কাউন্টারের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই ৭ জুলাইয়ের লালমনি ও রংপুর এক্সপ্রেসের সব টিকিট শেষ হয়ে যায়।
উপায়ান্তর না পেয়ে আবার লাইন ধরেছেন জান্নাত এবং তার মতো কয়েশ তরুণী ও নারী। তেমনই একজন নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার সুমি খাতুন। তিনি শনিবার রাত ৯টায় এসেও দিনাজপুরের ট্রেনের টিকিট পাননি। ভোর ৬টায় আসেন তাঁর বোন জিন্নাতুন খাতুন। তার তো পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
জিন্নাতুনের ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়েরের বয়স ১৫ মাস। দুপুরের বৃষ্টিতে ভ্যাপসা গরমে শিশুটি কষ্ট পাচ্ছিল। জিন্নাতুন বসে ছিলেন ১৮ নম্বর কাউন্টারের লাইনে ২০-২৫ জনের পরে। সিরিয়াল হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে উঠতেও পারছিলেন না। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে ঘুমায় আবদুল্লাহ। বিকেল ৩টার দিকে দেখা গেল সুমি, জিন্নাতুন ও আবদুল্লাহ এক প্যাকেট খিচুড়ি ভাগ করে খাচ্ছেন।
ট্রেনের টিকিটের জন্য কেন এত কষ্ট করছেন- জানতে চাইলে জিন্নাতুনের জবাব, বাসে দুর্ভোগ আরও বেশি। সারাপথ বাচ্চা কাঁদে। তাই বাধ্য হয়েই ট্রেনের টিকিটের জন্য দিনরাত বসে আছেন কমলাপুরে। তার সিরিয়াল ৩৩। টিকিট পাবেন কিনা নিশ্চিত নন।
একই অনিশ্চয়তায় ভুগছেন শনিবার সন্ধ্যা থেকে রংপুর কিংবা লালমনি এক্সপ্রেসের যে কোনো শ্রেণির বগুড়ার তিনটি আসনের টিকিটের অপেক্ষায় কমলাপুরে বসে থাকা রফিক আহমদ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রিধারী এই তরুণ জানান, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আসার পর তার সিরিয়াল ৬৪। রোববার সিরিয়ালের প্রথম ৪৯ জন টিকিট পান। এরপর কাউন্টার থেকে বলা হয়, আর কোনো টিকিট নেই। এরপর আবার লাইনে দাঁড়ান রফিক। এবার তাঁর সিরিয়াল ২২।
রফিক বললেন, ছেলেরা তাও হাঁটাহাঁটি করে, ঘুমিয়ে রাত কাটাতে পারে। মেয়েদের খুব সমস্যা। একজন নারী বললেন, স্টেশনের বাইরে শৌচাগারে মেয়েদের জন্য ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মাঝরাতে সেখানে যেতে কিছুটা অন্ধকার পথ হয়ে যেতে ভয় হয়। এক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ে আর মোবাইল ঘেঁটে রাত পার করেছেন।
অদূরে শহরতলি কাউন্টারে রাজশাহী, খুলনা বিভাগের জেলাগুলোর ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। সেখানে অবশ্য ভিড় কম। পদ্মা সেতু চালুর ফলে খুলনার 'চিত্রা', 'সুন্দরবন' ও 'বেনাপোল' এক্সপ্রেসের টিকিটের লাইন উত্তরবঙ্গের তুলনায় সামান্যই। ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ভর্তিচ্ছু সাবিক হোসাইন জানালেন, রোববার সকালে এসেছেন। তাঁর সিরিয়াল ৭৪। ভোরে বসুন্ধরা এলাকা থেকে আসা মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ওমর ফারুকের ২১।
সে তুলনায় রাজধানীর 'ধূমকেতু', 'সিল্ক্কসিটি', 'পদ্মা' এবং 'বনলতা' এক্সপ্রেসের লাইন বেশ দীর্ঘ। রোববার বিকেল ৪টায় প্রায় ২০০ টিকিটপ্রত্যাশীকে লাইনে দেখা যায়। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, যাত্রীর তুলনায় টিকিট সামান্য। সবাইকে তো দেওয়া যাবে না।
ট্রেনের টিকিট বিক্রির অপারেটর সহজ-সিনোসিস-ভিনসেন্ট জেভি জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকা থেকে ৩২ হাজার ১৫৩টি আসনের টিকিট বিক্রি করা হবে। এর মধ্যে ৭ জুলাইয়ের ট্রেনের টিকিট ২৫ হাজার ৪৪৯টি। অনলাইনে ১৩ হাজার ৩৩৬টি এবং কাউন্টার থেকে ১২ হাজার ১২৩টি আসনের টিকিট বিক্রি হয়েছে। রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সাড়ে ১৪ কোটি হিট হয়েছে ট্রেনের টিকিটের সার্ভারে।
মন্তব্য করুন