পাঠাও- রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম। তবে ২০১৫ সালে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটি শুধু রাইড শেয়ারিংয়ের বৃত্তে আটকে থাকেনি। ব্যবসার বৃত্ত বেড়েছে আরও। ফুড ডেলিভারি, কুরিয়ার, অনলাইন শপ ও পার্সেল কার্যক্রমও মেলে পাঠাও ডিজিটাল সার্ভিসে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই 'পাঠাও' ব্যবসার আড়ালে প্রতিষ্ঠানটির কিছু মার্চেন্টের হিসাব নম্বরে সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ মিলেছে। নিয়মিত টাকা গেছে এমন কিছু লেনদেনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। লেনদেনের গড়বড় তথ্য সামনে আসার পর এটি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানি লল্ডারিং ইউনিটও।

বিএফআইইউর তদন্তে বলা হয়েছে, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে তা ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ধারায় এটি অপরাধ।

পাঠাওর দুই শীর্ষ কর্মকর্তা হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াস ও সিফাত আহমেদ আদনানের সঙ্গে সন্দেহজনক লেনদেনে নাম আসা ওমর ফারুক ও হাবিবুর রহমানের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের পক্ষে মত দিয়েছে বিএফআইইউ। ইলিয়াস ও সিফাত বর্তমানে পাঠাওর বোর্ড পরিচালক। পাঠাওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস একসময় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ছিলেন। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য মিলেছে।

ওমর ফারুককে ঘিরে রহস্য :ঠাকুরগাঁওয়ের মারাধর গ্রামের মহারাজপুরের ওমর ফারুক। তাঁর বাবার নাম আবদুল কাইয়ুম। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর মার্কেন্টাইল ব্যাংক রংপুর শাখায় তিনি হিসাব খোলেন। গত ২২ মার্চ পর্যন্ত ওই হিসাবে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা লেনদেন হয়। হিসাব খোলার সময় কেওয়াইসি ফরমে আয়ের উৎস হিসেবে ফারুক প্রথমে নিজেকে 'ছাত্র' বলে উল্লেখ করেন। পরে পেশা হয়ে যায় 'ব্যবসা'।

বিএফআইইউর তদন্ত বলছে, পাঠাওর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বর থেকে ওমর ফারুকের হিসাব নম্বরে নিয়মিত টাকা গেছে। ওই টাকা জমা হওয়ার ব্যাপারে গ্রাহক ওমর ফারুক সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এমনকি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজেরা তদন্ত করে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে ওমর ফারুকের জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে।

পাঠাওর কুরিয়ার সেবা প্রদানকারী ওমর ফারুকের সঙ্গে অনলাইন জুয়ার সংশ্নিষ্টতা সামনে আসায় নড়েচড়ে বসে অন্য সংস্থাগুলো। ফারুক তাঁর হিসাব নম্বর থেকে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির হিসাব নম্বরে বিভিন্ন সময় টাকা স্থানান্তর করেছেন। এর মধ্যে টি থ্রি কমিউনিটির হিসাব নম্বরে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, বুস্ট এজেন্সিতে ২ লাখ ১০ হাজার, আকাশ ব্যাপারীর দুটি হিসাব নম্বরে প্রায় ২৯ লাখ টাকা, কিউ জুয়েলার্সে ২৩ লাখ টাকা ও এক্সট্রেতে ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা স্থানান্তরের তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া নওগাঁর সালাফ টেকনোলজির কর্ণধার হাবিবুর রহমানের হিসাব নম্বরেও টাকা পাঠিয়েছেন তিনি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওমর ফারুকের 'নিউট্রি গ্রিন' নামে একটি ভুঁইফোঁড় ফেসবুক পেজের অনলাইন ব্যবসাও রয়েছে।

তদন্তকারীদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, ইস্টার্ন ব্যাংকে পাঠাও লিমিটেডের নামে ৯টি হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি হিসাব নম্বর থেকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরে নিয়মিত বিভিন্ন অঙ্কের টাকা স্থানান্তর হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবটি ওমর ফারুকের। এ ছাড়া এই ঘটনায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মোট তিনটি হিসাব নম্বরের তথ্য খতিয়ে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে ফারুকের হিসাব নম্বরে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ মাসে পাঠাওর ইস্টার্ন ব্যাংকের হিসাব নম্বর থেকে মোট ১৯৩টি বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্কের (বিএফটিএন) ২ কোটি ২২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা জমা হয়। এই লেনদেন স্বাভাবিক নয় বলে মনে করছে তদন্ত সংস্থা।

অনলাইন জুয়ার তথ্য-প্রমাণ :ওমর ফারুক অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি তাঁর হিসাব নম্বর থেকে নওগাঁর নাজিরপুরের সালাফ টেকনোলজির স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমানের হিসাব নম্বরে টাকা স্থানান্তর করেছেন। এ কারণে হাবিবুরকেও রাখা হয়েছে সন্দেহের তালিকায়। ওমর ফারুকের হিসাব নম্বর থেকে হাবিবুরের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নজিরপুর শাখার দুটি হিসাবে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা জমা হয়। তদন্তকারীরা যে কারণে হাবিবুরকে সন্দেহের তালিকায় রাখছেন এর অন্যতম কারণ হলো- ইলেকট্রনিক নো ইয়োর কাস্টমার (ই-কেওয়াইসি) ব্যবহার করে ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট নজিরপুর শাখায় একটি হিসাব খুলে ৩৩ দিন পরিচালনার পর একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। হিসাব খোলার ফরমে আয়ের উৎস হিসেবে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন থেকে আয় উল্লেখ করা হলেও পেশা হিসেবে 'চাকরিজীবী' লেখা হয়। তাঁর মাসিক আয় উল্লেখ করা হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। ব্যাংক হিসাব খোলার তথ্যের সঙ্গে তাঁর ব্যাংকিং লেনদেন পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। হাবিবুরের সঞ্চয়ী একটি হিসাব নম্বরে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ওমর ফারুকের হিসাব নম্বর থেকে গেছে। এ ছাড়া নওগাঁর নজিরপুর শাখায় হাবিবুর রহমানের আরেকটি চলতি হিসাব নম্বর ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খোলা হয়। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সেই হিসাব নম্বরে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা লেনদেন হয়। বর্তমানে ওই হিসাব নম্বরে জমা আছে ৯ হাজার ২০৬ টাকা। হাবিবুরের চলতি হিসাব নম্বরে ওমর ফারুকের কাছ থেকে ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা স্থানান্তর হয়। রংপুরের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গ্রাহক ওমর ফারুকের কাছ থেকে নওগাঁর হাবিবুর রহমানের হিসাব নম্বরে অর্থ স্থানান্তরকে সন্দেহজনক বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জরিমানা :তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা, মূল্য তালিকা না দেখানো, পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের প্রতারিত করার দায়ে ১৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এই তালিকায় পাঠাওর নামও আছে।

পাঠাও এমডি যা বলছেন : পাঠাওর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ বলেন, পাঠাও হলো ই-কমার্স ডেলিভারির অন্যতম বৃহৎ সেবা যার মাধ্যমে ৪০ হাজারের বেশি ই-কমার্স ও এফ কমার্স মার্চেন্টদের ডেলিভারি সেবা প্রদান করা হয়। ডেলিভারি শেষে পাঠাও পণ্যের গ্রাহক থেকে নগদ টাকা সংগ্রহ করে। এরপর সেই টাকা পাঠাওর ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। পরে পাঠাও সেই সংগৃহীত টাকা মার্চেন্টের নিবন্ধিত হিসাবে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে পাঠায়। পাঠাওর মার্চেন্টদের অন্তর্ভুক্ত করার সময় যথাযথ কেওয়াইসি যাচাই করা হয়। ওমর ফারুক ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পাঠাওর একজন মার্চেন্ট। পাঠাওর একজন মার্চেন্ট হিসেবে ফারুকের অনবডিং ও ডেলিভারি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন ও বিধি মেনে এসেছি। পাঠাওর একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পেমেন্টস লিমিটেডের পেমেন্টস সিস্টেম প্রোভাইডার (পিএসপি) লাইসেন্সের আবেদনের প্রক্রিয়ায় একটি চেকের পরিপ্রেক্ষিতে ওমর ফারুককে ঘিরে অনুসন্ধানের বিষয়টি উঠে এসেছে। আমরা আশ্বস্ত করতে পারি, পাঠাও দেশের সব আইনকানুন মেনে রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, ই-কমার্স লজিস্টিকস পরিষেবা দিয়ে থাকে।