- বাংলাদেশ
- বন্যায় সিলেটের সড়কজুড়ে ক্ষত
বন্যায় সিলেটের সড়কজুড়ে ক্ষত

ছবি: ইউসুফ আলী
বন্যার পাশাপাশি সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের বিভিন্ন এলাকার সড়ক নিশ্চিহ্ন হয়েছে। সড়কের এক পাশ থেকে অপর পাশে যাওয়ার সময় বানের পানি শুধু পিচ নয়; সড়কের মাটি ও ইট-পাথর খুবলে নিয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জে এখনও বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদর ও বিয়ানীবাজারে কিছু সড়ক এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) প্রাথমিকভাবে ১৬৬ কিলোমিটার সড়কের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছে, যা মেরামতের জন্য অন্তত সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। একইভাবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতাধীন অনেক সড়কের বিভিন্ন জায়গা নতুন করে নির্মাণ করতে হবে; যাতে প্রয়োজন ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নগরীর ভেতরে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) আওতাধীন সড়ক সংস্কারে প্রয়োজন আরও দুইশ কোটি টাকা।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ থেকে ফতেহপুর হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেছে সওজ। এই সড়কের গোলাপগঞ্জ অংশের ফতেহপুর মাঝপাড়া, হাওরতলা ও মানিকোনা এলাকায় রাস্তার কোনো চিহ্ন নেই। মাত্র তিন কিলোমিটারের ব্যবধানে স্থানীয় এলাকাবাসী সুপারি গাছ, বাঁশ ও বস্তা দিয়ে সাঁকো নির্মাণ করেছেন। গত শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, পানির তোড়ে সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ২-৩ ফুট গভীর করে মাটি-পাথর-বালু উঠে গেছে। কোথাও ৫০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত রাস্তা পানিতে ভেসে গেছে। ভাদেশ্বর-মীরগঞ্জ ও মীরগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া দায়। মাত্র তিন বছর আগে ভাদেশ্বর-কাদিপুর সড়ক নির্মাণ করেছিল এলজিইডি।
ভাদেশ্বর ইউনিয়নের গোটারগাঁও গ্রামের হেনু মিয়া বলেন, শেখপুর-গোটারগাঁও দুই ইউনিয়নের ১৬টি গ্রামের মানুষ এই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। বন্যায় অনেক জায়গায় সড়কের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এলাকাবাসী বাঁশ ও সুপারি গাছ দিয়ে ভেঙে যাওয়া রাস্তায় সাঁকো নির্মাণ করেছেন। এতে ঝুঁকি নিয়ে হালকা যানবাহন চলাচল করছে।
গত মে মাসের বন্যায় জেলায় সওজ, এলজিইডি ও সিসিকের প্রায় ৫৮২ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় নগরীতে আড়াইশ কিলোমিটার, এলজিইডির ২৬৭ কিলোমিটার ও সওজের আওতাধীন ১০টি সড়কের ৬৫ কিলোমিটার প্লাবিত হয়। গত জুন মাসের মাঝামাঝি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মাসখানেক আগের পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে যায়। সুনামগঞ্জের সঙ্গে সিলেটের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা তিন দিনের জন্য পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল। অনেক জায়গায় রাস্তা ৩-৪ ফুট পর্যন্ত তলিয়ে থাকায় সিলেটের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
সিলেট-জকিগঞ্জ ও নগরীর বুরহানউদ্দিন সড়ক থেকে কানাইঘাট পর্যন্ত সড়কের অবস্থাও তথৈবচ। বন্যার পানিতে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের রানাপিং চৌঘরি থেকে গাছতলা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তায় বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বুরহানউদ্দিন-কানাইঘাট সড়কের গাছবাড়ি বাজার এলাকায় ৩৫-৪০ ফুট রাস্তা বন্যার পানিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ অবস্থায় এলাকাবাসী বাঁশ দিয়ে সাঁকো নির্মাণ করেছিলেন। সড়কের ভাঙা অংশের দুই প্রান্তে গাড়ি বদল করে কোনো রকমে যাতায়াত করতেন মানুষ। সর্বশেষ ঈদের আগে মাটি ও ইট দিয়ে জায়গা ভরাট করার পর সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাছবাড়ি বাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল খালিক।
কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে সীমান্তবর্তী সুরাইঘাট পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বন্যার কারণে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে সুরাইঘাট বিজিবি ক্যাম্প-সংলগ্ন জায়গায় ২৫-৩০ ফুট সড়ক বিলীন হয়ে যায়। মাটি ভরাট করে বর্তমানে কোনো রকমে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দরবস্ত-কানাইঘাট সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সওজ সাময়িক মেরামত করে। সর্বশেষ বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত কালভার্ট সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সওজ সাময়িকভাবে মেরামত করেছে। গোয়াইনঘাটে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, পূর্ব জাফলং, মধ্য জাফলং ও রুস্তমপুর ইউনিয়নের সড়কের অবস্থা বেহাল।
বিশ্বনাথ উপজেলা সদর থেকে খাজাঞ্চি, লামাকাজী ও ছালিয়া সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কুশিয়ারা নদীতীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের মধ্যবাজারের রাস্তা এখনও তলিয়ে রয়েছে। এ উপজেলায় নির্মাণাধীন অবস্থায় চানপুর থেকে দনারাম সড়ক দীর্ঘ এক মাস পানিতে তলিয়ে ছিল। এতে সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পিচ ও ইট উঠে গেছে। সওজ ও এলজিইডির প্রকৌশলীরা জানান, টেকসই উন্নয়নের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো পুনর্নির্মাণ ছাড়া গতি নেই।
সিলেট সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় কিছু সড়ক এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। পানি নামলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হবে। প্রাথমিকভাবে জেলার ১৭টি সড়কের ১৬৬ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছোট-বড় গর্তের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় বন্যার পানিতে পুরো সড়ক নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এসব জায়গা মাটি ও ইট দিয়ে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক সড়ক প্রকল্পের আওতায় মেরামত বা সংস্কার করতে হবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার মতো লাগবে। আজ সোমবার সওজের প্রধান কার্যালয় থেকে একটি টিম সিলেটে আসছে। এ টিমের যাচাই-বাছাইয়ের পর সবকিছু চূড়ান্ত হবে।
সিলেট নগরীর ভেতরে সিসিকের পাশাপাশি সওজের আওতাধীন বেশকিছু সড়ক রয়েছে। নগরীর ভেতরে সিলেট-তামাবিল ও সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কিছু অংশ দীর্ঘদিন পানিতে প্লাবিত ছিল। এ ছাড়া নগরীর তালতলা, তোপখানা, উপশহর, তেররতনসহ সুরমা নদীতীরবর্তী বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এসব সড়ক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর মধ্যে কিছু স্থান মেরামত করা হয়েছে। নগরীর ভেতরে সওজের যে সড়কগুলো রয়েছে, তা দ্রুত মেরামত করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
গত শনিবার ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ, তাজপুর ও ইলাশপুর এলাকায় সড়কের সার্বিক অবস্থা সরেজমিন দেখেন সিলেট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইনামুল কবীর। তিনি বলেন, কুশিয়ারা নদীতীরের এই সড়কগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মে মাসের বন্যায় ৩৭৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছিল। এবার তার তিন গুণ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন