সরকারের ভ্রান্তনীতির ফলে দেশে বর্তমানে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজন। তাঁরা বলেছেন, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতাই দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের বড় কারণ। দেশের প্রকৃত অবস্থা জাতিকে জানানো দরকার। জ্বালানি ও রিজার্ভ নিয়ে প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন করতে হবে।

সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তাঁরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। অনুসন্ধান করে দেশীয় গ্যাস আবিস্কার করা জরুরি। কুইক রেন্টালের মতো আত্মঘাতী প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। যে কোনো উপায়ে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা আরও বলেন, সব মিলিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কম গ্যাস অনুসন্ধান হয়েছে বাংলাদেশে। গ্যাস অনুসন্ধান করে না পেলে আমদানিতে যাওয়া উচিত ছিল। রিজার্ভ বাড়াতে হবে। এখন সংকট গভীরে চলে গেছে।

দেশে চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে সমকালকে বিরোধী রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। সারাদেশে লোডশেডিংও বাড়ানো হয়েছে। সবাইকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সরকারের কঠোর সমালোচনা করছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

তাদের মতে, দেশে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বেসরকারীকরণ এবং কুইক রেন্টালের মতো প্রকল্পের কারণে আজকের এ সংকট তৈরি হয়েছে। এসব প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।

সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সরকার সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিদ্যুৎ খাতকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে তিনি মনে করেন, এই পরিকল্পনা দুরভিসন্ধিমূলক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। বিদ্যুতের বিদ্যমান আইন জলাঞ্জলি দিয়ে সংসদে নতুন আইন পাস করা হয়েছিল। যাকে ইচ্ছা তাকে পাওয়ার স্টেশন দেওয়া হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতের দেশ বলে হাতিরঝিলে অনেক ফানুস উড়ল; কিন্তু দেশবাসী আজ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগে তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ বিদ্যুৎ নিয়ে সফলতার দাবি করলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। ১০-১২ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সরকারের হাতে রাখার দরকার ছিল। সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করত তাহলে আজকের পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। অন্ধকারে থেকে পেমেন্ট করতে হচ্ছে, যেটি অতীতে দিতে হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও কুইক রেন্টাল কোম্পানিকে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। যারা লাভবান তারা জনগণের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার করেছে।

তিনি বলেন, এখনও সরকারের অর্থমন্ত্রী বলছেন- তাঁদের রিজার্ভ কিংবা অর্থের কোনো সংকট নেই। তাহলে বিদ্যুতের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান তেল আমদানি করতে সমস্যা কোথায়? সরকারকে দেশের প্রকৃত অবস্থা জাতির সামনে জানাতে হবে। তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সরকারের দূরদৃষ্টির অভাবে আজকের এই সংকট। তারা অপরিকল্পিতভাবে পাওয়ার প্লান্ট তৈরি করেছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নেই। ওই পাওয়ার প্লান্টকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।

বিশিষ্ট নাগরিক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, দেশের এই সংকটে সবাইকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। আগে সরকারের কর্মকর্তা কিংবা সরকারি অফিসে এই ব্যয় সংকোচন নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। বাসাবাড়ি এবং বিভিন্ন অফিসে ৫০ ভাগের মতো এসি বন্ধ করতে হবে। মন্ত্রীদের শতভাগ এসি বন্ধ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করে বাসে, পাবলিক বাসে চলাচল করার নিয়ম করতে হবে। কিন্তু সবার আগে কুইক রেন্টাল বন্ধ করতে হবে। জনগণের রক্তের টাকা দিয়ে এ ধরনের প্রকল্প চালু রাখার কোনো মানে হয় না।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অর্থ পাচারের প্রবণতা থেকে আগে সরে আসতে হবে। এরপর মহাপরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে ঢেলে সাজাতে পারলে এই সমস্যা থাকবে না। যে কোনো উপায়ে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। যেভাবেই পারে ব্যবসার ক্ষতি না করে জ্বালানি ক্রয়ে বিভিন্ন উৎস বের করা এবং রিজার্ভ আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা দিয়ে যদি জ্বালানি সরবরাহ চেইন ঠিক রাখতে পারে তাহলে সমাধান আসবে। এ সমস্যা তো এক দিনে তৈরি হয়নি। কিন্তু সরকার দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই করেনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনা করলে দেশের বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। এটাই হচ্ছে মৌলিক কথা। এ ছাড়া সমাজতন্ত্রের নীতি অবলম্বন করে এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করতে পারলে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। তবে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, দেশের সব সংকটের বড় দিক হচ্ছে অব্যবস্থাপনা। এখন রাতারাতি এই অব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে না। তবে এখন থেকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। সবার সঙ্গে কথা বলে পর্যায়ক্রমে এই অব্যবস্থাপনা কাটিয়ে ওঠার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

বিষয় : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট

মন্তব্য করুন