একটি নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে সারাদেশে টেকসই সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের সময় ও ব্যয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যা দ্রুত সম্প্রসারণশীল যোগাযোগ খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে তারা আশাবাদী। সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ফজলে রব্বে বাসসকে বলেন, ‘আমরা এই ন্যানো প্রযুক্তি পণ্য অ্যাক্রিলিক পলিমার ব্যবহার করে মাসে ১০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে পারি।’ তিনি বলেন, প্রাথমিক গবেষণায় একটি বিশেষজ্ঞ দল এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের যেকোনো ধরনের মাটির জন্য উপযোগী এবং এটি সড়ক নির্মাণ ব্যয় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেবে।

গবেষণায় ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্বদানকারী সওজ-এর এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অ্যাক্রিলিক পলিমার-নির্মিত সড়কগুলোর দীর্ঘ স্থায়িত্বের কারণে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হবে খুবই কম। আমাদের বিশ্বাস, পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (ফোর্থআইআর) যুগে প্রবেশের পথ সুগম করবে এবং আরো উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হলো এটি এখন আমাদের হাতের নাগালে এসে পৌঁছে গেছে।

সড়ক যোগাযোগ সম্প্রসারণের চাহিদা ফলে গত বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের যোগাযোগ খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থ বছরের বাজেটে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জন্য ৩১২ দশমিক ৯৬ শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, যা মোট উন্নয়ন বাজেটের ১২.৭ শতাংশ। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৮০ দশমিক ৪২ শ’কোটি টাকা।

নির্মাণ প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণাপত্রে ‘অ্যাক্রিলিক পলিমার’কে ন্যানো প্রযুক্তির অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে- এটি মাটিকে সুদৃঢ় ও সুস্থিত করার ক্ষেত্রে অসাধারণ একটি উপাদন, যার পানি প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে এবং এতে ক্ষতিকর রাসায়নিক এবং অথবা জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন হয় না। অ-বিষাক্ত এবং অদাহ্য এই প্রযুক্তিটি পরিবেশ বান্ধব।

রব্বে অ্যাক্রিলিক পলিমারকে ‘প্রায় অবিনশ্বর’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তার গবেষণা দলের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী যে, এই প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত রাস্তাগুলো কমপক্ষে ৫০ বছরের মতো টেকসই হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ হবে ন্যূনতম।

গবেষক দলের সিনিয়র সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন বলেন, কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকার মাতারবাড়িতে অ্যাক্রিলিক পলিমারের মাঠ পরীক্ষায় প্রযুক্তিটিকে ‘অত্যন্ত কার্যকর’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি জানান, তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২২টি জেলা থেকে মাটি সংগ্রহ করে মাতারবাড়ি এলাকায় কে. ৩১ এপিএস অ্যাক্রিলিক পলিমার দিয়ে বিভিন্ন অনুপাতে পরীক্ষা করেছেন। একই সঙ্গে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সড়ক অবকাঠামোগত উপাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরামর্শক সংস্থাগুলোর ভারপ্রাপ্ত দলনেতা হোসেন বলেন, তারা একটি আর্থিক বিশ্লেষণও করেছেন এবং দেখেছেন এটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী।

রব্বে বলেন, এটি খুব সস্তা, টেকসই এবং সহজ রাস্তা নির্মাণের পদ্ধতি এবং বাংলাদেশের মাটিও অ্যাক্রিলিক পলিমারের সঙ্গে মেশানোর জন্য খুবই উপযোগী। দলটি এপ্রিল ২০২১ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত দশ মাস ধরে প্রযুক্তিটির কার্যকারিতা এবং সম্ভাব্যতার উপর একটি বিস্তৃৃত গবেষণা চালিয়েছে। তারা এটিকে সওজ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) মতো সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে। গবেষক দলের সদস্যরা বলেন, প্রযুক্তিটি দ্রুততার সঙ্গে এবং অনেক কম খরচে ড্যাম ও বাঁধ নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

নির্মাণ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অ্যাক্রিলিক পলিমার বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে, ভারত এবং ভুটানও রাস্তা নির্মাণের জন্য এটি ব্যবহার করা শুরু করেছে।

সমীক্ষা দলের একজন সদস্য বলেছেন যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী সফলভাবে কাশ্মীরের দুর্গম ও পাহাড়ি লাদাখ অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর শিলিগুড়িতে কে.৩১ এপিএস ব্র্যান্ডের অ্যাক্রিলিক পলিমারের সফল ব্যবহার করেছে।

প্রযুক্তিটির কৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রব্বে বলেন, ‘সনাতন পদ্ধতিতে ইট ও পাথর কুচি সড়কের ভিত্তি ও উপ-ভিত্তি নির্মাণের প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ায় কোনো পাথর বা ইটের প্রয়োজন হবে না। এর অর্থ, নতুন প্রযুক্তি ইট পোড়ানোর প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বায়ুু দুষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সূত্র: বাসস


বিষয় : টেকসই সড়ক নির্মাণ পলিমার প্রযুক্তি অ্যাক্রিলিক পলিমার

মন্তব্য করুন