
বিশ্বজুড়ে নানা সংকটের মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য মজুতের উদ্যোগ নেয় সরকার। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বিদেশ থেকে আমদানি- এ দুই লক্ষ্যের দিকে নজর থাকলেও সরকারের সেই পরিকল্পনায় ছেদ পড়েছে। এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তবু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দিশা মিলছে না। উল্টো নিম্নমানের চাল গছিয়ে দিচ্ছেন মিল মালিকরা। অনেক খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা জড়িয়েছেন অনিয়ম-দুর্নীতিতে। আবার কম শুল্ক্কে চাল আনার অনুমোদন নেওয়ার পরও আরও লাভের আশায় তা আমদানি করছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও চালের বাজার অস্থিরই রয়েছে।
জানা যায়, গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে শুরু হয় চাল সংগ্রহ অভিযান। এ কার্যক্রম শেষ হবে আগামী ৩১ আগস্ট। সরকার ২৭ টাকা দরে ধান এবং ৪০ ও ৩৯ টাকা দরে কিনছে চাল। এই বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ লাখ টন। তবে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ধান হাতে এসেছে মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫২৪ টন বা ৩০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর ১৩ লাখ টন সিদ্ধ চালের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৯০৮ টন বা ৬১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ৫০ হাজার টন আতপ চালের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ২৫ হাজার ৩১১ টন বা ৫০ দশমিক ৬২ শতাংশ। সেই হিসাবে সিদ্ধ চাল ৩৯ শতাংশ আর আতপ ৫০ শতাংশ সংগ্রহ এখনও বাকি। তবে জুলাইয়ের মধ্যে ৯০ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহের কথা ছিল। এ প্রেক্ষাপটে গত ২৪ জুলাই খাদ্য অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করে চিঠি দিয়ে বলেছে, যে গতিতে সংগ্রহ অভিযান চলছে, বাকি সময়ের মধ্যে শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
স্থানীয় কৃষক, চালকলের মালিক ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে স্থানীয় হাটবাজারে যে দামে মোটা জাতের ধান বিক্রি চলছে, গুদামেও সে দাম দেওয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে গুদামে ধান বিক্রি করতে চাচ্ছেন না কৃষকরা। কারণ, সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। আর্দ্রতার কথা বলে অনেক সময় ধান ফেরতও দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে গুদামে ধান শুকিয়ে ২-৩ কেজি কমানো হয়। তবে স্থানীয় বাজারে এসব ঝামেলা নেই। অন্যদিকে, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলাবাজারে মোটা চালের দাম বেশি হওয়ায় মিলারদেরও গুদামে চাল বিক্রিতে আগ্রহ নেই। এ কারণে অনেক খাদ্যগুদামের ওএমএস চাল কৌশলে ফের মজুত করা হচ্ছে। ওএমএসের চাল ডিলাররা গুদাম থেকে কেনেন ২৮ টাকা কেজি দরে। আর বাজারে চালের কেজি ৪০ টাকা। এতে প্রতি কেজি চালে লাভ হচ্ছে ১০-১২ টাকা। এসব টাকা আত্মসাৎ করছেন কিছু মিল মালিক ও খাদ্যগুদামের অসাধু কর্মকর্তা। খোদ খাদ্যমন্ত্রীর জেলা নওগাঁতেও এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক মিল মালিক নিম্নমানের চালও সরবরাহ করছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আমিনুল এহসান বলেন, 'আমরা চাল সংগ্রহে আশাবাদী, তবে সম্পূর্ণ ধান সংগ্রহ হবে না। লটারির মাধ্যমে যেসব কৃষক বাছাই করা হয়েছে, তাঁরাও গুদামে আসছেন না। কারণ, কৃষক খোলাবাজারে বেশি দর পাচ্ছেন। সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাইন উদ্দিন বলেন, বন্যায় অনেক ধান-চাল নষ্ট হয়েছে। এ জন্য সংগ্রহের পরিমাণ কম। নওগাঁর ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আলমগীর কবির বলেন, ওএমএসের চাল আবার মজুত হওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় মিলাররা আগে যেভাবে লাভ করতেন, এখন সেভাবে পারছেন না।
নিম্নমানের চাল সরবরাহ :অনেক খাদ্যগুদামে নিম্নমানের চাল সরবরাহ করছেন মিল মালিকরা। আর টাকা খেয়ে মানহীন লালচে ও গন্ধযুক্ত পুরান চাল নিচ্ছেন গুদামের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে নিম্নমানের লালচে ও গন্ধযুক্ত চাল সরবরাহের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য গত শনিবার তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা খাদ্য কর্মকর্তা। দিনাজপুরের হিলিতে লালচে, পোকা ধরা পুরোনো চাল সংগ্রহ করেন খাদ্য কর্মকর্তা। কুষ্টিয়ায় একাধিক গুদামে নিম্নমানের চাল সরবরাহ করায় অন্তত ৩০ ট্রাক চাল ফেরত পাঠানো হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪০০ টন। এর মধ্যে চালকল মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠনের সভাপতি আবদুর রশিদের রয়েছে ১০টির বেশি ট্রাক। ফরিদপুরের নগরকান্দায় অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে ৬০ টন চাল নিম্নমানের বলে সংগ্রহ করা হয়নি। তবে নগরকান্দা এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিল মালিকদের কাছে কমিশনের আশায় অন্য গুদামের চাল সংগ্রহ করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তদন্তকাজে বাধাও দিয়েছেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া মুস্তফা জানান, বিজয়নগরের খাদ্য কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফরিদপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন জানান, ১০ মাস আগের চাল এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে সরবরাহ করা হয়। এতে শুধু রং একটু পরিবর্তন হয় বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন জানান, ভালো চাল না হলে তা নেওয়া হচ্ছে না। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী জানান, জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, শর্ত পূরণ না করলে চাল ফেরত দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫টি ট্রাক ফেরত দেওয়া হয়েছে। কুষ্টিয়ায় সর্বোচ্চ মানের চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
মানহীন চাল সরবরাহের কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, 'নিজের ব্যর্থতার কারণে চাল ফেরত দিয়েছে। বৃষ্টির কারণে আর্দ্রতা বেশি ছিল। তবে খাদ্যগুদামের কর্মকর্তারা মানের ব্যাপারে কোনো আপস করেননি।'
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সমকালকে বলেন, 'যেভাবেই হোক এবারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। যদি কোনো কর্মকর্তা বা মিল মালিকের অবহেলার দায়ে সংগ্রহ কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তাহলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' তিনি বলেন, 'সংগ্রহ কাজ সফল করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়তই বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাও তদারকি করছেন।'
আমদানিও কম :বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ১০ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়। ২৫ শতাংশ শুল্ক্কে চাল আনছেন ব্যবসায়ীরা। তবে গত ৩০ জুন থেকে আমদানি প্রক্রিয়া শুরু হলেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩ লাখ টন চাল। আর বেসরকারি পর্যায়ে মজুত আছে সাড়ে ৭ লাখ টন। কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী অনুমোদন নেওয়ার পরও চাল আমদানি করেননি। ফলে আমদানি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও গত সপ্তাহের চেয়ে এই সপ্তাহে বাজারে চালের দাম বেড়েছে।
মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, বিশ্ববাজারে গম সংকট হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। ফলে আমদানি কম হচ্ছে। পুরো চাল আমদানির জন্য কিছুদিন সময় নিতে হবে। আর দ্রুত আমদানি করতে চাইলে শুল্ক্কের পরিমাণ আরও কমাতে হবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, এশিয়া মহাদেশে খাদ্য পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় খাদ্য সংকটের শঙ্কা নেই। তবে সচেতন থাকতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা দরকার।
মন্তব্য করুন