- বাংলাদেশ
- দরকার নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র
দরকার নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র

একুশ শতকের প্রথমার্ধে সারাবিশ্বে যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে; দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে; তখনই নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক জোর-জবরদস্তির একটা রূপ সর্বত্র দৃশ্যমান। সে শিল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল বা তৃতীয় বিশ্বেই হোক। প্রথম বিশ্বে নারীর হিজাব পরায় বাধা দেওয়া বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে হিজাবে ঢাকতে বাধ্য করার প্রবণতার মধ্য দিয়ে পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। আবার কর্মক্ষেত্রেও কিছু ছকে বাঁধা কাজকে নারীর উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী। দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী। বাংলাদেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৪টি। অর্থাৎ দেশের মোট কর্মজীবী মানুষের মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ নারী। যদিও কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় পুরুষের সমান, কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকেই নারীর এই অংশগ্রহণকে আমলে নেওয়া হয় না। নারীর ওই কাজকে গৃহকর্ম হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। যাক সে কথা। আধুনিক যুগে এসে যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের এত সুযোগ রয়েছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ এত কম কেন? তার জবাব একটাই- কর্মক্ষেত্রের বেশিরভাগই নারীবান্ধব নয়। কর্মজীবী নারীদের কাছ থেকেই জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে তাঁরা প্রায়ই প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হন। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা খুবই সীমিত। এমনকি অনেক জায়গায় তাঁরা আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। কেউ নারীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দাবি তুললে তাঁকে একটু নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। বাধ্য হয়ে অনেক নারীকে চাকরিই ছেড়ে দিতে হয়।
অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েও নারীদের বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই ছুটি যে একজন নারীর অধিকার- তা অনেকেই মানতে চান না। অনেক অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর মেয়েদের পদোন্নতিও আটকে দেওয়া হয়। অনেক সময় বেতন বাড়ানো হয় না। তা ছাড়া বেশিরভাগ অফিসেই ডে-কেয়ার সেন্টার বা ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় নারী কর্মীদের সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ছাড়া বেশিরভাগ দেশি করপোরেট অফিসে নারী কর্মীদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকে না। যে কারণে পিরিয়ডের সময় তাদের নানা অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি পিরিয়ডের সময় কোনো নারী অফিসে না গেলে তাঁকে জবাবদিহি করতে হয় এবং নেতিবাচক কথা শুনতে হয়।
এ ছাড়া নারীকে কর্মক্ষেত্রে বড় যে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়, তা হলো যৌন হেনস্তা। নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সেটা শ্রমঘন পরিবেশে যেমন; করপোরেট হাউসেও তেমন; সেই সঙ্গে অন্যান্য পেশাতেও। এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক এবং কখনও তা শারীরিকভাবে।
একজন নারী প্রশাসনে আছেন; না শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন; সেটা বিষয় নয়। বিষয়টি- তিনি নারী। নারী যে অবস্থানেই থাকুন; সেই অবস্থান থেকেই তিনি যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে নানা ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
নারী সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন গণপরিবহনে। এর ফলে নারীর কর্মক্ষেত্র নির্বাচনেও নির্দিষ্ট কিছু পেশা বেছে নিতে পরিবার থেকে প্রভাবিত করা হয়। নারীর জন্য চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলো এখনও সবার জন্য অবাধ হয়ে ওঠেনি।
মেয়েদের পোশাক ও কাজ তার রুচি-পছন্দের বাইরেও অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই 'পররুচি'র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পরিধান নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাক ও পেশার স্বাধীনতা বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরেন বা যে কাজ করেন, তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। আজও তা সুকৌশলে পুরুষ শাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়।
তবে আমাদের আইনগুলো যদি আরও নারীবন্ধব; সেই সঙ্গে মানসিকতায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়, তাহলে নারীর কাজের পরিধি আরও বাড়বে। সে জন্য নারীর কাজের স্বীকৃতি এবং সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রের জন্য সরকারের পাশাপাশি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। যার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ঝেড়ে ফেলার পথে এগোনো সম্ভব হবে। া
লেখক : কথাসাহিতিক
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী। দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী। বাংলাদেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৪টি। অর্থাৎ দেশের মোট কর্মজীবী মানুষের মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ নারী। যদিও কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় পুরুষের সমান, কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকেই নারীর এই অংশগ্রহণকে আমলে নেওয়া হয় না। নারীর ওই কাজকে গৃহকর্ম হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। যাক সে কথা। আধুনিক যুগে এসে যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের এত সুযোগ রয়েছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ এত কম কেন? তার জবাব একটাই- কর্মক্ষেত্রের বেশিরভাগই নারীবান্ধব নয়। কর্মজীবী নারীদের কাছ থেকেই জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে তাঁরা প্রায়ই প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হন। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা খুবই সীমিত। এমনকি অনেক জায়গায় তাঁরা আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। কেউ নারীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দাবি তুললে তাঁকে একটু নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। বাধ্য হয়ে অনেক নারীকে চাকরিই ছেড়ে দিতে হয়।
অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েও নারীদের বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই ছুটি যে একজন নারীর অধিকার- তা অনেকেই মানতে চান না। অনেক অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর মেয়েদের পদোন্নতিও আটকে দেওয়া হয়। অনেক সময় বেতন বাড়ানো হয় না। তা ছাড়া বেশিরভাগ অফিসেই ডে-কেয়ার সেন্টার বা ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় নারী কর্মীদের সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ছাড়া বেশিরভাগ দেশি করপোরেট অফিসে নারী কর্মীদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকে না। যে কারণে পিরিয়ডের সময় তাদের নানা অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি পিরিয়ডের সময় কোনো নারী অফিসে না গেলে তাঁকে জবাবদিহি করতে হয় এবং নেতিবাচক কথা শুনতে হয়।
এ ছাড়া নারীকে কর্মক্ষেত্রে বড় যে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়, তা হলো যৌন হেনস্তা। নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সেটা শ্রমঘন পরিবেশে যেমন; করপোরেট হাউসেও তেমন; সেই সঙ্গে অন্যান্য পেশাতেও। এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক এবং কখনও তা শারীরিকভাবে।
একজন নারী প্রশাসনে আছেন; না শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন; সেটা বিষয় নয়। বিষয়টি- তিনি নারী। নারী যে অবস্থানেই থাকুন; সেই অবস্থান থেকেই তিনি যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে নানা ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
নারী সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন গণপরিবহনে। এর ফলে নারীর কর্মক্ষেত্র নির্বাচনেও নির্দিষ্ট কিছু পেশা বেছে নিতে পরিবার থেকে প্রভাবিত করা হয়। নারীর জন্য চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলো এখনও সবার জন্য অবাধ হয়ে ওঠেনি।
মেয়েদের পোশাক ও কাজ তার রুচি-পছন্দের বাইরেও অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই 'পররুচি'র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পরিধান নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাক ও পেশার স্বাধীনতা বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরেন বা যে কাজ করেন, তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। আজও তা সুকৌশলে পুরুষ শাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়।
তবে আমাদের আইনগুলো যদি আরও নারীবন্ধব; সেই সঙ্গে মানসিকতায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়, তাহলে নারীর কাজের পরিধি আরও বাড়বে। সে জন্য নারীর কাজের স্বীকৃতি এবং সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রের জন্য সরকারের পাশাপাশি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। যার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ঝেড়ে ফেলার পথে এগোনো সম্ভব হবে। া
লেখক : কথাসাহিতিক
মন্তব্য করুন