ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

উত্তরের হাটের সবজি ঢাকায় ঢুকছে কম

উত্তরের হাটের সবজি ঢাকায় ঢুকছে কম

লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২২ | ১৪:২৩

রোদের তেজে সবুজ আখন্দের পরনের ছেঁড়া শার্টটা ঘামে চপচপ। বগুড়ার মোকামতলার এই পটোলচাষি হাতে মাইক আর ভ্যানগাড়িতে প্যাডেল মেরে ছুটছেন গ্রামের পথে-প্রান্তরে। ভ্যানে অন্তত দুই মণ পটোল। মাইকে হাঁকডাক দিয়ে দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে এই কায়দায় পটোল বেচাকেনা। তিন দিন আগেও আধা মণ পটোল পচে যাওয়ায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। এখন ফেরি করে পটোল বেচে খুব বেশি লাভ না হলেও পুঁজি হারানোর ভয়টা একদম উবে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে সবজি পরিবহনের ট্রাক ভাড়া বেড়েছে বেশুমার। ফলে ব্যবসায়ীরা ট্রাকে সবজি তুলছেন কম, হাটে সবজি কেনাবেচায়ও নেমেছে ধস। তাই সবুজ আখন্দের মতো অনেক চাষি উত্তরের সবচেয়ে বড় সবজি বাজার মহাস্থানহাটের পথে আর হাঁটছেন না। এভাবেই সবজি বেচছেন ফেরি করে।

ঢাকার পাইকার মুক্তার হোসেন। তিনি হতাশ কণ্ঠে বলছিলেন, 'বগুড়া থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ১০-১১ টন সবজি বহনে আগে ট্রাক ভাড়া ছিল ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। তেলের দাম বাড়ার কারণে এখন গুনতে হচ্ছে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এখান থেকে কম দামে সবজি কিনছি ঠিকই, তবে ঢাকায় এত বেশি ট্রাক ভাড়া দিয়ে পোষাব কেমনে। সঙ্গে আরও আছে পথের খরচা, শ্রমিকের খরচা। ভাবছি, এখন থেকে সবজি ঢাকার আশপাশ থেকেই কিনব।'

আবার মহাস্থানের চন্ডিহারার চাষি মজনু মিয়ার মাথায় যেন বাজ পড়েছে! বলছিলেন, পাঁচ বিঘা জমির সবটাতেই করেছিলাম সাঁচি লাউ আর মিষ্টি কুমড়ার চাষ। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ভালো দাম পেতাম। সবজির চাহিদা নেই, ট্রাক ভাড়া বেশি- হাটে এখন চলছে এসব অজুহাত। এ কারণে নেই লাউয়ের দাম। প্রতি পিস লাউ গতবারের চেয়ে ৮-১০ টাকা কম দরেও বেচতে পারছি না। লাউ তো আর রেখে দেওয়া যাবে না, পচবেই। বাড়িতে যেখানে ধান রাখতাম, সেখানে মিষ্টি কুমড়ার মজুত করেছি। বাজার কবে ভালো হয়, সে আশায় আছি।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পটভূমিতে বগুড়াসহ পুরো উত্তরাঞ্চলের সবজিচাষি ও ব্যবসায়ীরা পড়েছেন এ রকম দুর্বিপাকে। বিভিন্ন রুটে ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। বাড়তি ট্রাক ভাড়া দিয়ে সবজি ঢাকায় এনে পোষাতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে বাজার মন্দা অজুহাতে ঠকছেন মাঠের চাষিরা। তবে খুচরা বাজারে সব সবজির দাম বেড়ে দুই থেকে তিন গুণ হয়ে আছে। খুচরায় আগুন দামে বেচাকেনা হলেও এমন অনেক পচনশীল সবজি আছে, যেগুলো হাটে সংরক্ষণের অভাবে কৃষক ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীর দূরত্ব বেশি হওয়ায় পাইকাররা আশপাশের জেলা থেকে সবজি ঢাকায় নামাচ্ছেন। ফলে ট্রাক ভাড়াও একটু কম পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে দামে পোষাতে না পেরে পাইকাররা উত্তরের জেলা থেকে সবজি ঢাকায় আনছেন কম। এখন বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে গড়ে ৬০ শতাংশ সবজি ঢাকায় কম আসছে।

বগুড়ার ট্রাক বন্দোবস্ত সমিতির প্রতিনিধি আবুল কালাম দাবি করেন, এখন সবজির মৌসুম না, তবু তেলের দাম বাড়ার আগে একশর বেশি ট্রাক ঢাকায় যেত। এখন তা নেমে এসেছে ৩৫ থেকে ৪০টিতে। মূলত তেলের দাম বাড়ার পর ব্যবসায়ীরা কেউই পোষাতে পারছেন না।
আবুল কালাম বলেন, এখন তিন টনের একটি ট্রাকে সবজি বহন করা হচ্ছে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টন। আগে এই গাড়ির ভাড়া ছিল ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এখন সেই ভাড়া ১৫-১৬ হাজার টাকা। পাঁচ টনের ট্রাকে সবজি যায় ১৫ থেকে ১৬ টন। এই ট্রাকের আগে ভাড়া ছিল ১৬ হাজার, এখন সাড়ে ১৯ হাজার টাকা।

কমেছে সরবরাহ :বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে রাজধানীতে সবজি সরবরাহ অনেকটাই কমেছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, হাটে সবজি ঠিকই আছে, তবে পাইকার কমে গেছে। গত রোববার বেশ কয়েকটি ট্রাকে তোলা হচ্ছিল সবজি। গন্তব্য ঢাকার কারওয়ান বাজার। কোনোটিতে ঝিঙে, কোনোটিতে লাউ-চাল কুমড়া আবার কোনটিতে পটোল। ব্যবসায়ী গফুর মিয়া জানান, সবজির আমদানি আছে মোটামুটি। তবে ট্রাক ভাড়ায় নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন তাঁরা। ছোট ট্রাকগুলোর ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তিন টনের ট্রাকে কমবেশি ১০ টনের মতো সবজি ধরে। এই ট্রাকের ভাড়া এখন ১২ হাজারের বদলে নেওয়া হচ্ছে সাড়ে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা।

ট্রাকচালক রহিম উদ্দিন নিয়ে যাচ্ছেন কাঁকরোল, করলাসহ বিভিন্ন সবজি। তিনি জানান, বগুড়া থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে আসা-যাওয়ায় তাঁর সাড়ে তিন টনের ট্রাকে ডিজেল খরচ হবে ৯০ লিটারের মতো। সরকার নির্ধারিত নতুন দামে ডিজেলে খরচ হবে ১০ হাজার ২৬০ টাকা, যা আগের চেয়ে ৩ হাজার ৬০ টাকা বেশি। সঙ্গে চালক-হেলপারের বেতন ও রাস্তার খরচ তো আছেই। বাধ্য হয়ে তিনি ভাড়া বাড়িয়েছেন। আগে যেখানে প্রতিদিনই ট্রিপ (ভাড়া) পাওয়া যেত, এখন তা আর হচ্ছে না।

পাইকার সোহেল জানান, বগুড়া থেকে ঢাকায় সবজি নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাড়ে তিন টন ক্ষমতার একটি ট্রাকে ভাড়া বেড়েছে তিন থেকে চার হাজার টাকার মতো। এত দিন ভাড়া ছিল ১১-১২ হাজার টাকার আশপাশে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর নেওয়া হচ্ছে ১৫-১৬ হাজার টাকার মতো। একাধিক ট্রাকচালক বলেন, শুধু ঢাকা নয়; বগুড়া থেকে দেশের যেসব জেলায় সবজি যায়, তার প্রতিটি পথের ভাড়াই বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি।

ট্রাকচালক তৌফিক জানান, তাঁর মহাজনের ট্রাক রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে জ্বালানির দাম বাড়ার পর থেকে পাঁচটিই বন্ধ। বাকি দুটি দিয়ে সবজি পরিবহন চলছে। যাতায়াতে কিছু লাভ না থাকলে মালিক টিকবেন কী করে।
মহাস্থানহাট থেকে সবজি কিনে ঢাকার শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজারে সরবরাহ করেন ট্রাকচালক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, 'ডিজেলের দাম যখন ৬৫ টাকা লিটার ছিল, তখন ঢাকা থেকে বগুড়া আপ-ডাউন করতাম ৮-৯ হাজার টাকায়। যখন ৮০ টাকা লিটার হলো, তখন ভাড়া আরও ১ হাজার টাকা বাড়ে। এখন ১১৪ টাকা লিটার হওয়ার পর ৭ হাজার টাকার তেল লাগে।' তিনি আরও বলেন, 'ঢাকা থেকে আমরা বগুড়ায় আসি, একমুখী পথে ৮-৯ হাজার টাকাতেও আমাদের পড়তা পড়ে না। আজ চার দিন বগুড়ায় বসে আছি। ঠিকমতো খাওয়া নাই, ঘুমানো নাই। আবার ট্রিপও পাচ্ছি না। ঠিকমতো ভাড়া না পেলে আমরা চলব কী করে! বাধ্য হয়ে ট্রাক চালানো বন্ধ করে দিতে হবে।'

হাটের একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, তেলের দামের প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে সবজির দরেও। পাইকারির চেয়ে খুচরা বাজারে সবজির দাম বেড়েছে অনেক বেশি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় কোনো সবজি খুচরা বাজারে ৫০-৬০ টাকা কেজির নিচে নেই। হাটে এসব সবজির বেশির ভাগের দামই ২৫-৩০ টাকার মধ্যে। তার মানে দাম বাড়ানো হচ্ছে শুধু তেলের দাম বেশি হওয়ার কারণে।

হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি আমিনুল হক বলেন, মহাস্থানহাট থেকে রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, মেহেরপুর, যশোর, সাতক্ষীরায় সবজি যায়। একই ট্রাক অন্য মালপত্র নিয়ে বগুড়ায় ফিরে আসে। দূরত্ব ও ট্রাকের বহন ক্ষমতাভেদে ভাড়া বাড়ার হার ভিন্ন। ট্রাকচালকরা যে হিসাব তাঁদের দিচ্ছেন, সেই হিসাবে ভাড়া বেড়েছে ৩০ শতাংশের ওপরে। তারপরও ফিরতি ট্রাকে ভাড়া না পেলে বিরাট অঙ্কের ক্ষতি গুনতে হয়। আমিনুল বলেন, এখন এই হাট থেকে ৬০ শতাংশ ট্রাক লোড কমে গেছে।
ঢাকা আর বগুড়ার দামের ফারাক :রোববারের তথ্য অনুসারে মহাস্থানহাটে প্রতি ১০০ সাঁচি লাউয়ের পাইকারি দর ছিল ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৮০০, চাল কুমড়া ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা। এ ছাড়া পটোলের মণ ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, কাঁকরোল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, পেঁপে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, মুলা সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, বেগুন ও ঝিঙে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা, বরবটি ১ হাজার ২০০ টাকা, আলু ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, করলা ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা এবং কাঁচামরিচ সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা।

এই সবজিই ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাইকারি বিক্রি হয়েছে পটোল প্রতি কেজি ৩০-৩২, মিষ্টি কুমড়া ২৬-২৭, কচুর লতি ৩২-৩৫, চিচিঙ্গা ৩৫-৩৮, ঝিঙে ৩৫-৪০ ও কাঁচা পেঁপে ১৫-১৭ টাকা। মাঝারি আকারের লাউ প্রতিটি বিক্রি হয় ২৮-৩০ টাকা দরে।

খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে ঢাকার কাঁঠালবাগান, নিউমার্কেট ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের কাঁচাবাজার থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, সেখানে পটোল, কচুর লতি, ঝিঙে, ধুন্দল, বরবটির মতো মৌসুমি সবজি খুচরায় বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের আড়তে যে কাঁচা পেঁপে বিক্রি হয়েছে ১৫ টাকায়, তা খুচরা বাজারে ৪০ টাকা চান বিক্রেতারা। ভালো মানের গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০-৯০ টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দুই দিন আগেও এই বেগুন ৬০-৭০ টাকা ছিল।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের খুচরা বিক্রেতা আলমগীর জানান, কারওয়ান বাজারেই সবজির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। কারওয়ান বাজার থেকে পিকআপে সবজি আনতে ১ হাজার টাকার ভাড়া দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা লাগছে। এ কারণে সবজির বাড়তি দাম ধরেছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

×