- বাংলাদেশ
- অতিমূল্যায়িত উন্নয়ন প্রকল্প এখন লুণ্ঠনের মাধ্যম
অতিমূল্যায়িত উন্নয়ন প্রকল্প এখন লুণ্ঠনের মাধ্যম
ইআরএফ সংলাপে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অতিমূল্যায়িত উন্নয়ন প্রকল্প এখন অর্থ লুণ্ঠনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকার এমন প্রকল্প নিচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রতিপত্তি বেড়েছে বলে ধারণা দেওয়া যায়। কিন্তু প্রকল্প কতটুকু অর্থনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আবার এ ধরনের প্রকল্পের কাজ যারা পায়, তাদের যোগ্যতার চেয়ে সরকারের সঙ্গে সংযোগ প্রাধান্য পায়। যোগ্যতার অভাবের কারণে কাজ হাতবদল হয়। এতে করে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বেড়ে যায়।
গতকাল মঙ্গলবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সংলাপে পুঁজিবাদের বিকাশ পর্যায়ে অর্থ লুণ্ঠনের প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী।
ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
তিনি বলেন, পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে এক ধরনের লুণ্ঠন হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই পুঁজিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। লুণ্ঠনের পর এক পর্যায়ে সমাজ সভ্য হয়। প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করে। বাংলাদেশে প্রাথমিক লুণ্ঠন হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। শিল্প ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে এদেশে অনেকে ফেরত দেননি। তাঁরা অনেক বড়ও হয়েছেন। এরপর পুঁজিবাজার থেকে লুণ্ঠন হয়েছে। যেসব কোম্পানির কোনো ভিত্তি নেই তারা আইপিও ইস্যু করে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এখন লুণ্ঠন হচ্ছে সরকারি প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় অতিমূল্যায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে। বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে দেশে দেখা গেছে লুণ্ঠনের পরে ভালো বিচার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে; কিন্তু বাংলাদেশে এখনও তার ঘাটতি রয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, দেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে মেধাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিনিয়োগ বিকশিত হচ্ছে না। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে সরকার, মানুষ ও দেশের। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে। বিচারের সুযোগও তুলে নেওয়া হয়েছে। এখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে সংযোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের অর্থনীতিতে গত দশকে বড় অগ্রগতি হলেও চার ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ না হওয়া, কর আহরণের দুর্বলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি- মোটা দাগে এ চারটি বিচ্যুতির দিকে মনোযোগ না দিলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। এসব বিচ্যুতি ঠিক মোকােিবলা করা না গেলে পরবর্তী উত্তরণ পর্যায়ে সংকটে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এবার জিডিপির অভিলাষ সংযত করে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগের পরামর্শ অর্থনীতিবিদরা দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেন, বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিময় হার ও মূল্যস্ম্ফীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার দ্রুত নিরসন হবে না। বাংলাদেশের মূল সমস্যা আর্থিক খাতের দুর্বলতা। প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়া এর কারণ।
ড. দেবপ্রিয় উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দ্বারা ধাবিত। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি, জিডিপির ২৩ বা ২৪ শতাংশে আটকে আছে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ৫/৬ শতাংশ থেকে ৭/৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও খুব কম আসছে। এফডিআই জিডিপির এক শতাংশের নিচে, যা গতিশীল অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি হলে সেগুলোর সুবিধা নিয়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটেনি। ফলে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এক ইঞ্জিনে চলা অ্যারোপ্লেনের মতো, যা বেশি দূর যেতে পারে না। কিছু দূর চলার পর রানওয়ে খুঁজতে থাকে।
তিনি বলেন, এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে। এর অর্থ আয় বাড়ছে। তাহলে কর সংগ্রহ হচ্ছে না কেন। তাহলে কি আয় থেকে কর সংগ্রহ করা হচ্ছে না, নাকি আয়ের হিসাবের গরমিল আছে। কর সংগ্রহে ঘাটতি থাকার কারণে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে পারছে না। খাদ্য সহায়তা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে।
দেবপ্রিয় বলেন, সরকার ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, সে তুলনায় সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে করছে না। বাজেটে ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশ। শিক্ষায় ২ শতাংশ। রাজনৈতিক ঘাটতি পূরণের জন্য দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেখা যাচ্ছে। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগের ফলাফল আসতে দশকের বেশি সময় লাগে। রাজনৈতিক চক্রে এ সময় নেই। পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্জনও আছে। বিচ্যুতিও আছে। এ বিচ্যুতি অর্জনকে দুর্বল করে দিতে পারে। টেকসই কমিয়ে দিতে পারে। তবে বাংলাদেশ অনেক সমস্যা উত্তরণ করে এ অবস্থায় এসেছে। আশা করা যায়, আগামীতে সমস্যা উত্তরণ করে এগিয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে চাপ রয়েছে, তা সহসাই কাটবে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত থাকবে। যারা বলছেন শিগগিরই সংকট কেটে যাবে, তাঁরা বরং পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছেন এবং অনাস্থা বাড়াচ্ছেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিনিময় হার বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার সঙ্গে অর্থ পাচারের সংযোগ থাকতে পারে।
বৈষম্য বেড়েছে কিনা এ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খানা আয়-ব্যয় জরিপ ও শ্রমশক্তি জরিপের হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে অন্যান্য পরোক্ষ সূচক বিশ্নেষণ করে বলা যায়, বাংলাদেশে বৈষম্য আগের তুলনায় বেড়েছে। শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকেও বৈষম্য বেড়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সমালোচনা যাঁরা করেছিলেন, তার মধ্যে তিনিও আছেন, এখন কী বলবেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতিবিদরা তো পদ্মা নেতু নির্মাণ নিয়ে সমালোচনা করেননি। সাশ্রয়ী উৎসের ঋণে এরকম বড় অবকাঠামো নির্মাণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। পদ্মা সেতু অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি প্রকল্প।
সফল এক দশক :ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত এক দশক দেশের ইতিহাসে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিশীল দশক। বলতে হবে সফল দশক। এ সময়ে দেশ নিম্ন-আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ে উন্নীত হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে এসেছে। সফলভাবে এমডিজি অর্জন করেছে। এসডিজি বাস্তবায়নে এগিয়েছে। মানুষের আয়ুস্কাল, কৃষি উৎপাদন, শিক্ষার হার, মাথাপিছু রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে। বলতে হবে, গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে থেকে ১৩ বছর অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমৃদ্ধ সময়।
মন্তব্য করুন