স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর অর্জন অনেক। তবে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র বদলায়নি, বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। নারীবান্ধব অনেক আইন থাকলেও প্রায়োগিক দিক অত্যন্ত দুর্বল। এ অবস্থায় রিজার্ভেশন বা সংরক্ষণের মাধ্যমে মূল দুটি ধারা বাদ রেখে নয়, জাতিসংঘের সিডও সনদ পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন মহিলা পরিষদ আয়োজিত সভার বক্তারা।

আন্তর্জাতিক সিডও দিবস পালন উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে 'জাতিসংঘ সিডও কমিটির সমাপনী মন্তব্য (২০১৬): বাস্তবায়ন পর্যালোচনা' বিষয়ক এই কনসালটেশন সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীর আত্মহত্যার পরিসংখ্যানচিত্র আলোচনায় তুলে ধরা হয়।

সভাপতির বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সিডও সনদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সম্পূরক হিসেবে স্বীকৃত হলেও এই সনদ বাস্তবায়নে এখনও চ্যালেঞ্জ আছে। সরকার কর্তৃৃক নারীবান্ধব নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সিডও সনদের ২নং ধারা অনুমোদনের কোনো পদক্ষেপ নেই। সিডও-কে এখনও নারীর জন্য কল্যাণমূলক 'অ্যাপ্রোচ' হিসেবেই দেখা হচ্ছে, অধিকার হিসেবে নয়।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএনউইমেনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলি সিং বলেন, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুসারে এখনও সমতা প্রতিষ্ঠায় নানা বৈষম্য আছে। সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, বৈষম্যমুক্ত পলিসি, জেন্ডার ডিসেক্রিগেটেড ডাটা তুলে ধরার বিষয়ে জোর দিতে হবে।

ইউএন সিডও কমিটির সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, সিডও সনদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সমঝোতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সিডও সনদকে আইন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিগত ৩৭ বছরে সরকারের বিভিন্ন দল দেশ পরিচালনা করেছে কিন্তু সনদ বাস্তবায়নে সংরক্ষণ অব্যাহত রেখেছে, যা নারী-পুরুষের সমতা, নারী ক্ষমতায়নের পরিপন্থি। অথচ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশ সংরক্ষণ ছাড়া সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন দিয়েছে।

একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংখ্যা বৃদ্ধি করলে হবে না, গুণগত দিকের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করে ন্যায্যতা, সমতা প্রতিষ্ঠায় সিডও দলিল হলো একটা ইন্সটু্রমেন্ট। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। আইন বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতিবিদদের সরকারি প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করতে হবে, শিক্ষক, পুলিশ প্রশাসনকে জেন্ডার সেনসিটিভ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে মেধা ও পেশিশক্তি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।

দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষরের দীর্ঘ চার দশক অন্যতম ধারা ২ এবং ১৬ (১) (গ)-তে বাংলাদেশ সংরক্ষণ বজায় রাখার ব্যাপারে এখন বলছে, ধর্মীয় নেতারা সম্মত নন এবং সমাজ প্রস্তুত নয়। এখানে ভোটের রাজনীতি একটি ভূমিকা পালন করে।

তিনি বলেন, দেশে শিক্ষা, পেশা, ক্রীড়া, সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীরা অনেক এগিয়েছে, কিন্তু মূলগতভাবে ব্যক্তিমর্যাদা, পরিবারে ও সমাজে অধস্তন অবস্থান ও নিরাপত্তাহীনতা অব্যাহত আছে। সমাজমানস ও জনসংস্কৃতিতে ভাবাদর্শগত পশ্চাৎপদতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতি ও জনসচেতনতার জন্য জনসম্পৃক্ত কাজের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন।

সভায় আরও বক্তব্য দেন কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন অ্যান্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক হোমায়রা আজিজ, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্কগ্দুনী ত্রিপুরা, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, আন্তর্জাতিক সম্পাদক দেবাহুতি চক্রবর্তী প্রমুখ। আয়োজক সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেমের সঞ্চালনায় সভার শুরুতে সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খানের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা।