নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলার বিচারের জন্য ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকায় গঠন করা হয় তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। তবে প্রতিষ্ঠার চার বছর পরও বিচারকাজ পরিচালনায় ট্রাইব্যুনালের জন্য নেই নিজস্ব এজলাস বা আদালতকক্ষ। বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রেবতী ম্যানশনের তিন তলায় বিচারকক্ষ ভাগাভাগি করে চলে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। সকালে এই আদালতের এজলাসকক্ষে মানব পাচার দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ হয়। একই এজলাসে দুপুরের পর শুরু হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম।

এমন চিত্র শুধু ঢাকার আদালতের নয়। ৬৪ জেলার প্রায় সব আদালতেই আছে এজলাস ও জনবল সংকটসহ নানা সমস্যা। এ পরিস্থিতিতে মামলাজটে নাজেহাল হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলাজট কমানো ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
এবারের বাজেটে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য গত অর্থবছরের চেয়ে ১১০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে গত অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটের তুলনায় এবার বরাদ্দ কমেছে। গত অর্থবছরে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। তা ছিল মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ। এ হিসাবে এবারের বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ কমেছে দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারকদের দক্ষতা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় বিচারক ও জনবল নিয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন আছে প্রায় ৪০ লাখ মামলা। মামলাজটের কারণে বিচারপ্রার্থীরা বিচারবিমুখ হয়ে পড়তে পারেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মামলাজট ও জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

আইন ও বিচার বিভাগের বাজেট বরাদ্দ নিয়ে গত ২২ বছরের তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৯-২০০০ সালে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনেই বিচারের ব্যয় নির্বাহ হতো। তখন বাজেটে সামগ্রিক বরাদ্দ ছিল ১২৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৬ কোটি টাকা। ২০০১-২০০২ সালে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের (বিচার বিভাগ) জন্য পৃথক বরাদ্দের ব্যবস্থা চালু করে সরকার। ওই অর্থবছরে আইন বিভাগের জন্য ১৪৮ কোটি এবং সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১২ কোটি টাকা। মোট বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৩৭৮ শতাংশ। তবে এতে বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য কোনো বরাদ্দ ছিল না। বিচার বিভাগের উন্নয়নে প্রথম বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে বাজেটে (সংশোধিত) মোট বরাদ্দ ছিল ৭৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের ৬৬৪ কোটি এবং সুপ্রিম কোর্টের জন্য ৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও উন্নয়ন খাতে ছিল ১২ কোটি টাকা। বরাদ্দ মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এবারের বাজেটে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ ২৩০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, 'আইন ও বিচার বিভাগের জন্য কয়েক দশক ধরে বরাদ্দ থাকে দেশের মোট রাজস্ব বাজেটের শতকরা শূন্য দশমিক ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। এই বরাদ্দ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারের অন্য সব মন্ত্রণালয়ের তুলনায় সবচেয়ে কম বললে অত্যুক্তি হবে না। এর পরিণতি হলো ৪০ লাখ মামলার জট আর বিচার পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের বছরের পর বছর ধরে নাজেহাল ও নাস্তানাবুদ হওয়া।'

তিনি আরও বলেন, জনগণ যাতে ন্যায়বিচার পায় সে ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। কারণ বর্তমান হিসাবে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার মহাসড়ক বানাতে যে বরাদ্দ থাকে, তার প্রায় সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রয়েছে জনগণের বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য। পরিতাপের বিষয় হলো, বিচারাঙ্গনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁরাও বাজেট বরাদ্দ বা বৃদ্ধির দাবি করেন না। তাই তাঁদেরও বিচারহীনতার দায় আছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল সমকালকে বলেন, 'রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিচার বিভাগ। কিন্তু এখানে কিছু সংকট অত্যন্ত প্রকট। বিশেষ করে প্রায় ৪০ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এতে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হচ্ছে এবং বিচারপ্রার্থীরাও আদালতবিমুখ হয়ে পড়ছেন। এর উত্তরণ ঘটাতে হলে পর্যাপ্ত বিচারক ও জনবল নিয়োগ দিতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নও জরুরি। এসব করতে হলে বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট থাকতে হবে। আশা করছি, সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।'

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের অবকাঠামো ও লজিস্টিক সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এই সমস্যা দূর না হওয়া পর্যন্ত পদক্ষেপ নিতে থাকবে। সরকার বিচার বিভাগের সমস্যা সমাধানে কোনো কার্পণ্য করবে না। মামলাজট কমাতেও সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে আদালতের বিচার প্রক্রিয়া আরও সহজ, স্বচ্ছ ও গতিশীল হবে।