পোশাকশিল্পের পর গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের অন্যতম একটি রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়েছে ঔষধশিল্প। স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৯৮ ভাগ পূরণ করে, বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধ-পণ্য এখন বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশের ঔষধশিল্পের মোট বাজার মূল্য প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১.৩৮ শতাংশ।

১৯৫০-এর দশকে এ দেশের ঔষধ-পণ্যের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। অল্প কিছু স্থানীয় কোম্পানি ছিল। আজ স্থানীয় বাজার ছাপিয়ে, সারা বিশ্বের ঔষধ রপ্তানিকারক ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭১তম। দেশের ঔষধশিল্প-এর এই উত্থানের নেপথ্যে আছে কয়েকজন দূরদর্শী উদ্যোক্তার দৃঢ় সংকল্প, যারা আজ থেকে ৭০ বছর আগে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এই শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
 
১৯৫৮ সালে, স্যামসন এইচ চৌধুরী এবং তার তিন বন্ধুর মাত্র ২০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শুরু হয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালষের যাত্রা। আজ সেই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের ২০টি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কর্মী সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশি। ২০১২ সালে স্যামসন এইচ চৌধুরীর প্রয়াণের পর তাঁর ৪ সন্তানই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এই প্রতিষ্ঠান। এই চার সন্তানের একজন তপন চৌধুরী। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্কয়ার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
 
'প্রেরণার কথা’র তৃতীয় সিজনের প্রথম পর্বে অতিথি হয়ে এসেছিলেন স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী। এই সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন তার শৈশবকাল নিয়ে, শুনিয়েছেন স্কয়ার পরিবারের গল্প, জানিয়েছেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ও আগামীর বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অভিমত।
 
তপন চৌধুরীর জন্ম পাবনা শহর থেকে ১২ মাইল দূরের আতাইকুলা গ্রামে। পড়ালেখার হাতেখড়ি এই গ্রামেই। পরবর্তীতে পাবনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করার পর তিনি উচ্চশিক্ষার্থে চলে যান যুক্তরাজ্যে।
 
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে যোগদানের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, তপন চৌধুরী এর পুরো কৃতিত্ব তার বাবাকে দেন। বিদেশ থেকে ফিরে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই অনেকটা সময় স্কয়ার ফার্মার ফ্যাক্টরির ভেতরে কাটিয়েছি। কি করে ট্যাবলেট তৈরি হয়, কি করে সিরাপ তৈরি হয় এসব বিষয়ে অনেক আগ্রহ ছিল তখন। আমি ছোটবেলায় অনেক সময় প্যাকেজিং লাইনে কাজ করেছি। আগ্রহটা সবসময়ই ছিল এবং যখন লেখাপড়া শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে এসেছি তখন ফ্যাক্টরিতে অনেক সময় দিয়েছি।” উচ্চশিক্ষা শেষে বাংলাদেশে ফিরে পরবর্তীতে তিনি স্কয়ার ফার্মার মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন এবং দেশব্যাপী স্কয়ারের ঔষধ-পণ্য প্রচারণা এবং চিকিৎসক ও কেমিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতি কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
 
তপন চৌধুরী কিছু উল্লেখযোগ্য ও অনুসরণীয় মূল্যবোধের কথা বলেন যা থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় উঠে আসে। শুরু থেকেই স্কয়ারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী বিশ্বাস করতেন পরিবার হচ্ছে একটি শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস। যা স্কয়ারের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতেও প্রতিফলিত হয়। যেমন একটি পরিবারে সবাই একইসাথে বসে একই খাবার খান, স্কয়ারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ফ্লোর স্টাফ পর্যন্ত সকল কর্মীও দুপুরে একই মেন্যুর খাবার এক সঙ্গে বসে খান। এই রীতির মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠানে সকল কর্মীর জন্য সহায়ক একটি পরিবেশ তৈরী হয় এবং আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটা বৃদ্ধি পায়। তপন চৌধুরী বলেন, “স্কয়ারের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, আমরা বলি এটা ‘স্কয়ার পরিবার’… ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন আমার বাবা, আমার মাও কিন্তু অনেক সহযোগিতা করেছিল। আমার মা সবসময়ই কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদেরকে পরিবারের মতো করে দেখার উপদেশ দিতেন।  এবং স্কয়ারের সকল প্রতিষ্ঠানে এখনও সেই মতাদর্শ মেনে চলা হয়।”
 
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস দিয়ে শুরু করলেও স্কয়ার গ্রুপের ব্যবসা বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা, ভোগ্যপণ্য, টেক্সটাইলস্ এবং মিডিয়া সহ প্রভৃতি খাতে বিস্তৃত। একটি ব্যবসা নিয়ে যাত্রা শুরু করে আজ একটি বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হওয়া প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী বলেন, “সত্যি বলতে কি গ্রুপ অব কোম্পানির চিন্তা-ভাবনা কখনই আমাদের ছিল না…ফার্মাসিউটিক্যালে আমরা খুব দ্রুতই সাফল্য পেয়ে গিয়েছিলাম। খুব অল্প সময়েই আমরা ক্যাশ-রিচ কোম্পানিতে পরিণত হলাম। এই সফলতাকে এরপর আমরা শুধুমাত্র একটি ব্যবসার বৃত্তে রাখতে চাইনি।” ফার্মাসিউটিক্যালের পর স্কয়ার প্রথমে টয়লেট্রিজ উৎপাদনে প্রবেশ করে। এরপর আশির দশকের শুরুতে যখন বাংলাদেশে রেডিমেড গার্মেন্টস্ ব্যবসায় সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তখন স্পিনিং মিলস্ প্রতিষ্ঠা করে টেক্সটাইলস্ ব্যবসায় প্রবেশ করে স্কয়ার। আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে কেনিয়াতে নিজ উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
 
এভাবেই একটা একটা করে স্কয়ারের ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে স্কয়ার প্রথম শেয়ার মার্কেটে প্রবেশ করে। এ প্রসঙ্গে তপন চৌধুরী একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা বর্ণনা করেন। “ইনিশিয়াল পাব্লিক অফারিং-এ আমার বাবা ঘোষণা দেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতি শেয়ার ক্রয়ে স্কয়ার টেক্সটাইলের একটি শেয়ার বিনামূল্যে দেওয়া হবে। তবে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সে সময় একটি নির্দেশনা জারি করে জানায় কোনো শেয়ার বিনামূল্যে দেওয়া যাবে না। কিন্তু বাবা বলেন, ‘আমি কথা দিয়েছি আমার শেয়ারহোল্ডারদের।’ নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তিনি হাইকোর্টে মামলা করেন…বাবার কথা ছিল এই যে- নিজের দেয়া কথা রাখতে তিনি হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্ট, যেখানে যেতে হয় তিনি যাবেন। অবশেষে, হাইকোর্ট আমার বাবার পক্ষে রায় দেন।” আস্থা এবং বিশ্বাসের ভিতের ওপর দাঁড় করানো এই প্রতিষ্ঠান আজও সেই মতাদর্শ অনুসরণ করেই ব্যবসা পরিচালনা করে চলছে।
 
বর্তমানে আমাদের তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হবার প্রবণতা তৈরী হয়েছে। এ বিষয়ে তপন চৌধুরী বলেন, “আমাদের অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়েরা রয়েছে যারা বিভিন্ন স্টার্টআপ তৈরী করছে। আমি তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। এখন ব্যাংকও তাদেরকে সহযোগিতা দিচ্ছে এবং সরকারও এগিয়ে আসছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তাদেরকে আরও অনেক বেশি সহযোগিতা দেওয়া দরকার ... তবে এই উদ্যোগগুলোর অধিকাংশই নিজেদের পণ্য বা সেবাটিকে সঠিক উপায়ে বানিজ্যিকীকরণ করে উঠতে পারছে না, এবং এর ফলে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছতে পারছে না।” এছাড়াও, এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখা, এবং স্বাস্থ্যের প্রতি সুনজর দেয়ার উপদেশ দেন তপন চৌধুরী।
 
 
নিজের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তপন চৌধুরী বলেন, “আমি অনেক সৌভাগ্যবান বাংলাদেশের মতন একটা দেশে আমার জন্ম হয়েছে। কারণ আমি এ দেশের সব জায়গাতেই সম্ভাবনা দেখি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বলি যে দেশটা আমার, এদেশের সব কিছুই আমাদের। এখানে যদি আমরা কিছু ভালো কাজ করতে পারি, যদি ভালো কিছু তৈরি করতে পারি। দেশটা সুন্দর হবে, এটাই আমাদের তৃপ্তি, এটাই আমাদের বড় পাওনা।” এ প্রসঙ্গে তিনি তার বাবার থেকে পাওয়া শিক্ষা উল্লেখ করে বলেন, “আমার পিতা একটা কথা সবসময় বলতেন যে ‘দেখ বাবা, একটা ভালো কাপড় পরলে লোকে সুন্দর বলবে, একটা ভালো গাড়ি চড়লে বলবে, হ্যাঁ, খুব সুন্দর। কিন্তু কালকে কিন্তু এই কথা কিছু মনে রাখবে না। কিন্তু তুমি যদি একটা ভালো মানুষ হও, এটা কিন্তু অনেকদিন মনে রাখবে। তুমি যদি একটা ভালো প্রতিষ্ঠান তৈরি করো, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ তোমাকে মনে রাখবে।’ তো এগুলো আমার জীবনে খুব ইম্পরট্যান্ট লাইফ লেসন।” দেশের প্রতি তপন চৌধুরীর ভালোবাসা, এদেশের মানুষের কল্যাণে কিছু করার প্রত্যয় তার কথায় প্রতিফলিত হয়, “আমরা যদি দেশের জন্য কিছু ভালো করতে পারি সেটাই আমার অবদান। কালকে আমি চলে যাবো, তখন আর কি? যদি একটা ভালো জিনিস করে যাই, সেটাই কিন্তু মনে থাকবে।”
 
প্রেরণা ফাউন্ডেশন কর্তৃক সম্প্রচারিত প্রেরণার কথা’র অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র অধ্যাপক ড. মেলিতা মেহজাবিন এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। প্রেরণার কথা’র তৃতীয় সিজনের প্রথম পর্বের সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি দেখা যাবে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের ইউটিউব চ্যানেলে: https://youtu.be/Rkz_UHbLL2E