সাফ জয়ের পেছনে প্রত্যেক খেলোয়াড়দের আলাদা আলাদা কিছু হৃদয়বিদারক গল্প আছে, যা অনেকের কাছেই হয়তো অজানা। এমন অনেক খেলোয়াড় আছেন যারা দলে সুযোগ পাননি। তাদের একজন হচ্ছেন শাহেদা আখতার রিপা। এসএসসি পরীক্ষার জন্য খেলায় অংশ নিতে পারেননি তিনি। দলে সুযোগ না পাওয়ায় রিপাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন একটি পোস্ট করেছেন তার বড় ভাই ফারুক হোসাইন।

রিপার বড় ভাইয়ের ফেসবুক পোস্ট

ফেসবুকের সেই পোস্টে রিপার ভাই ফারুক হোসাইন লিখেছেন, 'রিপা ২০১৬ সালে সোনাই ছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্ট–এর সেরা গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় (ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা) পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম ম্যাচে ২টি গোল (ফেনী জেলার বিপক্ষে)। দ্বিতীয় ম্যাচেও ২টি গোল (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপক্ষে) জয়লাভ করে সেমিফাইনালে বান্দরবান–এর বিপক্ষে ১-০–তে আমাদের স্কুল হেরে যায়। দুই দিন পর জানতে পারি রিপা বিভাগীয় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়।'

বড় ভাই রিপাকে নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে ফাইনালের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে রিপা পুরস্কারটি গ্রহণ করে। তারপর সন্ধ্যায় বাড়িতে পৌঁছায়। স্কুল পর্যায়ে যখন খেলত, তখন অনেকই উৎসাহ দিত, আবার কেউ কেউ আমার মা-বাবাকে বলত, মেয়েরা ফুটবল খেলে নাকি? তবে মা–বাবা তেমন কানে নিত না।

রিপা বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হওয়ার পর চিন্তা করলাম ফুটবল নিয়ে ভবিষ্যৎ কী চিন্তা করা যায়! এর ২০ দিন পর শামসুল আলম ভূলু স্যার খবর দিলেন জেলা পর্যায়ের অনূর্ধ্ব-১৪ দল বাছাই হবে।

সানাউল্লাহ স্যার আর শামসুল আলম সোহাগ (বুট মৌজা, সিনগার্ড) ভূলু স্যার একটা জার্সি দেন রিপাকে। ট্রায়ালের দিন আমি আর রিপা কক্সবাজার স্টেডিয়ামে পৌঁছালাম বেলা ৩টায়। মোট ২৫ জন ট্রায়ালে অংশ নিয়েছে। রিপা একদমই ছোট ছিল, তখন মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে। রিপাকে প্রথমে ট্রায়ালে না দিলেও পরবর্তী সময় শাহীন ভাই আসার পর রিপাকে মাঠে নামানো হয়। রিপা নামার পর ৫ মিনিটে ২টি গোল করে। রিপা প্রথম লিস্টে সিলেক্টেড জেলা পর্যায়ের অনূর্ধ্ব-১৪ টিমের।

অনূর্ধ্ব-১৪ টিমের হয়ে রিপা নোয়াখালী খেলতে যায় এবং প্রথম ম্যাচে ৮-১ গোল ব্যবধানে হেরে যায় এবং দলের একমাত্র গোলটি করে রিপা।

বাড়ির পাশে মাঠ ছিল, তাই রিপা নিয়মিত ফুটবল খেলত। এরপর চিন্তা করলাম রিপাকে কোথায় ভর্তি করানো যায়, বা কোথায় ফুটবলের ট্রেনিং নিতে পারবে।

এর এক মাস পর বিকেএসপির ট্রায়ালের সুযোগ হয়। রিপা কখনো বাসেও তেমন এত লং জার্নি করে নাই। ঢাকায় বিকেএসপি ট্রায়ালের জন্য মোহাম্মদ হোসেন বড় ভাই, রিপা সন্ধ্যায় গাড়িতে উঠে এবং সকাল ৮টায় পৌঁছায়। সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে খেয়েছিল, আর সকালে কিছুই না খেয়ে ফরম পূরণ করে ট্রায়ালে অংশ নেয়। এক দিনের ট্রায়ালে রিপা ১০-১২টি গোল করে এবং ৭ দিনের ট্রায়ালের জন্য সিলেক্ট হয়। ট্রায়াল শেষে সন্ধ্যায় আবার ও গাড়িতে উঠে সকালে বাড়িতে পৌঁছায়।

৭ দিনের ট্রায়ালে গিয়ে রিপা ফুটবলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়। রিপাকে না নেওয়ার যথেষ্ট একটা কারণ ছিল, তার হাইট ছিল অনেক ছোট। তবু তার মেধায় ও সবার দোয়ায় প্রথম হয়।

ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ ভর্তি হওয়ার ফরমের জন্য আমি বিকেএসপিতে গেলাম (আমার প্রথমবার ঢাকা যাত্রা)। বিকেএসপিতে দেখা হলো জয়া আপুর সঙ্গে, উনিও বিকেএসপির মহিলা কোচ হিসেবে যোগদান করেছেন। উনি অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ। রিপার ফুটবলের প্রথম কোচও উনি। এখন বাংলাদেশের একমাত্র ফিফা রেফারি।

২০১৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েও ভর্তির অনিশ্চয়তা ছিল। প্রিয় সানা উল্লাহ স্যার ও প্রিয় শামশুল আলম সোহাগ আংকেল রিপার ভর্তির পুরোপুরি দায়িত্ব নেন। (এলাকাবাসী ও অনেক সহযোগিতা করেন) বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার ফুটবলের সব সরঞ্জাম কিনে দেন। কক্সবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অনুপ বড়ুয়া অপু দা রিপাকে ৫ হাজার টাকা দেন। যে টাকাটা আব্বার ওষুধ খরচ ও পরিবারের বাজার খরচ হয়ে যায়। এখনও সানা উল্লাহ স্যার এবং সোহাগ আংকেল হয়তো এই ৫ হাজার টাকার বিষয়ে জানে না। হয়তো আজকেই জানবে।

আলহামদুলিল্লাহ রিপা বিকেএসপিতে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। ভর্তির দিন হোসেইন বড় ভাই রিপাকে নিয়ে ঢাকা গিয়ে ভর্তি করে দিয়ে আসে। রিপা তখন কক্সবাজারের লোকাল ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বলতে পারত না। বিকেএসপিতে ৩টি মাস কোনো কথা বলত না, শুধু শুনত। ৩ মাস পর্যন্ত লেগেছে ভাষা শিখতে।

এর পরের গল্পই নিশ্চয়ই অনেকের জানা। বিকেএসপির হয়ে ভারতের সুব্রত মুখার্জি গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচে ৪০ সেকেন্ডে রিপার পা থেকে প্রথম গোল আসে। জয়া আপু ছিল টিমের কোচ। খেলা কোনো চ্যানেলে না দেখার কারণে দেখতে পারতাম না খেলা শেষে জয়া আপুকে টেক্সট করতাম জয়া আপুও খুব খুশি হয়ে রিপ্লেই দিত। রিপা ১ গোল করেছে এবং ভালো খেলেছে। প্রত্যেক ম্যাচে আমি জয়া আপুকে বিরক্ত করতাম, খেলা শেষে জয়া আপুও রেজাল্ট জানিয়ে দিতেন। রিপা ধারাবাহিকভাবে ৪ ম্যাচে ৪ গোল করে এবং বিকেএসপি প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ভারতের মাটিতে। আহা!! কি আনন্দ।

২০১৮ সালে যুব গেমস এ বিকেএসপি থেকে ৫ জন টাঙ্গাইল জেলার হয়ে খেলতে যায়, টাঙ্গাইল এর কোচ ছিল গোলাম রায়হান স্যার ও ম্যানেজার মন্নি মন্নি মোনালিসা ম্যাডাম। দুজনের পরিশ্রমে টাঙ্গাইল জেলা জাতীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন হয়, পুরো টিমের অবদানে, রিপা (সেরা গোলদাতা) হয়। পরে জেএফএ কাপ টুর্নামেন্টে আবার ও জাতীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন, রিপা (সেরা গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়) হয়।

এই দুটি টুর্নামেন্ট এর পারফরম্যান্স নিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন কোচ গোলাম ছোটন স্যার রিপাকে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক দেয়। আলহামদুলিল্লাহ জাতীয় দলেও ডাক পড়ে রিপার।

রিপা এরপর সাফ অনূর্ধ্ব-১৫, এফসি অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৮ ও ২০২১ সালে সাফ অনূর্ধ্ব -১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন। ২০১৭ সালে যখন সাবিনা আপু, মারিয়া, কৃষ্ণা, সানজিদার খেলা টিভিতে দেখতাম তখন আমিও স্বপ্ন দেখতাম একদিন রিপা ও তাদের সঙ্গে খেলবে। ঠিক চার বছর পর ২০২১ সালে তাদের সঙ্গে খেলে রিপা সেরা গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় হয়। পুরো টিমের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।

এইবার বলি সাফ চ্যাম্পিয়নদের গল্প।

সাবিনা আপু অনেক বাধা-বিপত্তির পর নিজেকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে সমাজ থেকে অনেক বাধা পেয়েছেন। পরিবারের সাপোর্ট না থাকলে আজ শিরোপা জেতা সম্ভব হতো কি জানি না।

মারিয়ার বাবা নেই, পরিবারের দায়িত্ব এখন মারিয়ার হাতে। খুব কষ্টে বেড়ে ওঠা মারিয়া, কৃষ্ণা আখি, স্বপ্না, শিউলি, সানজিদা, মাসুরা, নিলা, রিতু, মনিকা, আনাই, আনুচিং, শামসুন্নাহার (সিনিয়র, শামসুননাহার (জুনিয়র) আরও যারা টিমের সদস্য ছিল, তাদের বেড়ে ওঠা অভাবের মধ্যে দিয়ে। তারা দের প্রত্যেকেই গ্রামে বেড়ে ওঠা এবং ছোট কাল থেকে খুব কষ্টের সঙ্গে দিন কেটেছে। প্রত্যেকের গল্পের সঙ্গে আমার ছোট বোন রিপার গল্পের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই। রিপাকে আমি বড় ভাই হিসেবে সাপোর্ট দিয়েছি। অনেকের বড় ভাই ও নেই৷ তারা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে শুনেছে মেয়েরা ফুটবল কেন খেলে? তখন তাদের পরিবার কি মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে কেউ কি একটু ভেবে দেখেছেন? আজ তারাই গিয়ে ট্রফি উদ্‌যাপন ও পরিবারকে সমর্থন জোগাচ্ছে। এইটাই সমাজের বাস্তব চিত্র। সানজিদার ফেসবুক স্ট্যাটাস'টি পড়েছি, সেটা ভাইরাল ও হয়েছে।

;যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।'

জেতার আগে দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে সানজিদারা। সফলতা আসতে একটু সময় লাগে। আর সেই সময়কে পিছপা না হয়ে নিজের স্বপ্নে এগোলে একদিন সফল হবেই। সেই কাজটা করেছেন চ্যাম্পিয়ন টিমের কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন স্যার। আজ নিউজে দেখলাম উনার বন্ধুরা উনাকে বলত ওই যে দেখ মহিলা কোচ চলে যাচ্ছে। ছোটন স্যারের অনেক বেশি ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়৷ উনি এই কথাটা বলার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করেছেন। কাল বলেছেন অবশেষেই।

আজ বন্ধুরা হয়তো তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতেছেন। কারণ, সারা বাংলাদেশ প্রশংসা করতেছেন তার। আবার কেউ হয়তো হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন।

ছোটন স্যার, আপনার পরিশ্রমের ফসল সবাই দেখত পেল। এই বছর কোরবানির ঈদে কাউকে ছুটিতে আসতে দেয়নি। সবাই ঈদ করেছে বাফুফে ভবনে। পরিবারেরও আক্ষেপ ছিল, কিন্তু সেই আক্ষেপটা গতকাল মুছে গেছে। অভিনন্দন ছোটন স্যার।

আমি রিপার অভিভাবক হিসেবে বাফুফে ভবনে গেলেই বুঝতে পারি চ্যাম্পিয়ন টিমের সব প্লেয়ার সব অভিভাবকের আপ্যায়ন কীভাবে করে। অনেকেই তাদের সেলিব্রিটি বললেও তারা কতটা আন্তরিক, মিশুক, নির্লোভ, নিরহংকার। তারা এখনো শিখে নাই অহংকার জিনিসটা কী। তারা খুব সাদামাটাভাবে চলাফেরা করে ও সবাইকে কত সম্মান দেয়। আমি মিনিমাম ৫-৬ বার গিয়েছি ফেডারেশন ভবনে। সবাই চ্যাম্পিয়ন, সবাই আমাদের বোন।

গতকাল পুরো টিমের অবদান, প্রত্যকেই নিজের সেরাটা দিয়ে খেলেছে। সাবিনা আপু (সেরা গোলদাতা ও টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়), রুপনা (সেরা গোলরক্ষক) সাফের ব্যক্তিগত পুরস্কার সব বাংলাদেশেই নিয়েছে।

ম্যাচ জেতার পর সবার যে উৎসাহ ও সেলিব্রেশন দেখলাম, সেভাবে যদি সব সময় আমরা মহিলা টিমকে সাপোর্ট করি, তাহলে খুব বেশি দূরে নয় ইনশা আল্লাহ একদিন আমাদের বোনেরা বিশ্বকাপে খেলবে।

রিপার এসএসসি পরীক্ষা থাকার কারণে দলের সঙ্গে নেপাল যেতে পারেনি। দোয়া করবেন রিপার জন্য। রিপা দলে থাকুক বা না থাকুক বাংলাদেশ জিতলে জিতে যায় প্রত্যেক প্লেয়ারের পরিবার। কারণ, অনেকের এই ফুটবলের আয় দিয়ে সংসার চলে, রিপার আয়েও আমার বাড়িতে বড় কন্ট্রিবিউশন আছে।

আমি এত ভালো লিখতে পারি না। অনেকের হয়তো নাম বাদ গেছে। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।’