পৃথিবীতে যেসব জাতি আজ উন্নত, প্রতিটি জাতির ভাগ্যে এমন কোনো না কোনো নেতার আবির্ভাব ঘটেছে, যিনি পুরো জাতির খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন। সাবেকি সব ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন এক নির্মিতির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। যেমন যুবরাজ হেনরি ইউরোপের ছোট্ট দেশ পর্তুগালকে দিজ্ঞ্বিজয়ী করে তুলেছিলেন; রানী প্রথম এলিজাবেথ ঘরকুনো ইংরেজদের বিশ্বজয়ে বের করিয়েছিলেন; লি কুয়ান আফিমখোর সিঙ্গাপুরিয়ানদের করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

এ রকম কোনো যুগস্রষ্টার জন্য একটি জাতি যুগের যুগ অপেক্ষায় থাকে। যাদের ভাগ্যাকাশে এমন নেতা আসে তারা উতরে যায়। নইলে সম্পদের পাহাড় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে। যেমন কঙ্গো, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলার কথা বলা যায়।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অমিত সম্ভাবনার পাশাপাশি অসীম বিদ্রূপ নিয়ে। খাদ্য ঘাটতি অথচ প্রবলভাবে কৃষিনির্ভর একটি জনপদ কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সেটা অনেকের কাছে উদ্বেগের বিষয় ছিল। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো অনেকেই একে 'বটমলেস বাস্কেট কেস' বলেছিলেন। সেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। কিন্তু '৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটা 'ভোকাট্টা' রাষ্ট্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ। জান্তা-জানোয়ারের কোয়ালিশনে ২১ বছর কেটে যায় বাংলাদেশের। সেই দিগ্‌ভ্রান্ত তরণিকে বাতিঘর দেখানোর সুযোগ পেয়েছিলেন জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বেশি সময় পাননি সে যাত্রায়। ক্ষণকালের আভা ছড়িয়ে মিলিয়ে যেতে হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে। কিন্তু অনিবার্য হলে ঠিকই ফিরে আসতে হয়। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার পরের গল্প রোমাঞ্চ জাগানো। ক্ষমতায় আসার মাত্র দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো একটা নৃশংস ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় জননেত্রীকে। 'ফুল ফুটিবার আগে ঝরিয়া গেল'- এমন একটা মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। সেখান থেকে অসীম ধৈর্য আর দৃঢ়তায় জাতিকে পরিত্রাণের পথে নিয়ে আসেন তিনি।
তারপর যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই ষড়যন্ত্রের কাঁটা। পদ্মায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে থাকা বাংলাদেশকে জুড়ে দিতে সেতু করার উদ্যোগ নিলেন। কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির কলঙ্ক দিয়ে সরে পড়ল বিশ্বব্যাংক। টনটনে আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগল। নেত্রী বললেন, আমরা নিজের টাকায় সেতু বানাব। চারদিকে রে রে উঠল। কিন্তু লক্ষ্যস্থির নেতৃত্ব যাকে বলে, গোঁ ধরে রইলেন। এক যুগ পর সেটা করেই দেখালেন তিনি। মেট্রোরেল, এপপ্রেসওয়ে, গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র- একটার পর একটা উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিলেন। বিরোধীরা এসবকে রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, সবই আজ বাস্তব। তীব্র বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে শাসনকাল শুরু করার সময় লোকে বিদ্যুৎ গেলেই উপহাস করে বলত- 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'। শেখের বেটি দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিদ্যুৎ সংকট থাকবে না। সেটাই হয়েছে। যখন একটার পর একটা বাধার পাহাড় টপকে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ, তখনই শুরু হলো আগুন সন্ত্রাস। স্পেনে যেমন জেনারেল ফ্রাঙ্কো সোশ্যালিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন যুদ্ধ, অনেকটা সে রকম। সেটাও তিনি সামলে নিলেন দৃঢ় হাতে। তারপর মৌলবাদের উত্থান। লোকে ভেবেছিল এ দেশ আফগানিস্তান হতে বেশি সময় লাগবে না। অকুতোভয় নেত্রী জানিয়ে দিলেন- যতদিন তাঁর হাতে নৌকার লগি ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
এত কিছুর পর পথ হারায়নি বাংলাদেশ। ২০০৯ থেকে ২০২২- বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো এক পর্ব।
ভুখা-নাঙা আর খাদ্য ঘাটতির দেশে এখন না খেয়ে থাকা ইতিহাস। একরত্তি ভূমি নিয়ে সারাবিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, আম ও পেয়ারায় অষ্টম, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়।
শিল্পে বাংলাদেশের বিকাশ হয়েছে অভাবনীয়। একসময় গৃহস্থালি ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানি করতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা চলে যেত। এখন বাংলাদেশের পণ্য ইউরোপে পর্যন্ত যাচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির গাড়ি পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে দেশে। শেখ হাসিনা সরকারের সাহসী নেতৃত্বে দেশ সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আউটসোর্সিং করে অনেক তরুণের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয়। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে গিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পাওয়া যায় না। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চীনের পরই। ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো চাহিদা পূরণ করার জন্য বিদেশে পর্যন্ত কারখানা খুলছে।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকার যখন ক্ষমতা ছেড়ে যায় তখন দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, এখন তা ২০ শতাংশের নিচে। অতিদারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ২৩ থেকে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। গড় আয়ু ৬৫ বছর থেকে হয়েছে ৭৩ দশমিক ২ বছর। গড় আয়ুতে আমরা ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন- মাত্র ৮৮ ডলার। সর্বশেষ হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। মাথাপিছু আয়েও আমরা ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়ে এসেছি।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীকে ২০২১-এর ৩ অক্টোবর মূল্যায়ন করেছে, বাংলাদেশ টেলস দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যা রিমার্কেবল স্টোরি অব পোভার্টি রিডাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। এর আগে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থ্থা দ্য স্ট্যাটিস্টিকস বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
২০২০ সালের প্রথমার্ধ থেকে বৈশ্বিক অতিমারির কারণে সারাবিশ্বের উৎপাদন ব্যবস্থা থমকে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তানের মতো অনেক দেশ লকডাউন দেওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু জননেত্রী কঠোরভাবে লকডাউন দিয়েছেন। নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তখন নিন্দুকরা পৈশাচিক আনন্দে মেতেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার বন্যা বয়ে যেত। বলা হয়েছিল অন্তত দশ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। তছনছ হয়ে যাবে জননেত্রীর জয়যাত্রা।
নেত্রী যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল আমরা তখন দারুণভাবে উপলব্ধি করেছি। ঘরে বসেই অফিস, ঘরে বসেই ক্লাস, ঘরে বসেই ই-কমার্স করেছে লোকজন। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে এর ঝাপটা তেমন প্রবল হয়নি। সে বছর মাত্র ২২টি দেশে ধনাত্মক জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। রপ্তানি বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, রিজার্ভ বেড়েছে। ফলে করোনা ব্যবস্থাপনায় যে কয়টি দেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতে।
পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। এবার খুলে যাবে মেট্রোরেল। তারপর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু স্পেশাল ইকোনমিক জোন, কপবাজার রেললাইন। একটার পর একটা স্বপ্ন বাস্তব রূপ পাবে বছরখানেকের মধ্যে। যেন ঘুম থেকে উঠেই আমরা দেখতে পাব এক নতুন বাংলাদেশ।
বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে 'এইজ অব ডিসকভার' অথবা 'এইজ অব ডেভেলপমেন্ট' আছে। হয়তো বাংলাদেশ এ রকম একটি পর্ব অতিক্রম করছে। একদিন এ নিয়ে গবেষণা হবে। আমরা গর্বভরে বলব, শেখের বেটির শাসন দেখেছি। এইজ অব ডেভেলপমেন্টে আমিও কাজ করেছি। আমিও শেখ হাসিনার লোক ছিলাম।
শুভ জন্মদিন জননেত্রী। আপনার জন্মদিন বারবার ফিরে আসুক আমাদের প্রেরণার দিন হয়ে। আপনার শতায়ু কামনা করি। ২০৪১-এ উন্নত দেশের বন্দরে বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়ে তবেই তো আপনার অবসর।

ডা. এসএম মোস্তফা জামান: অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়