- বাংলাদেশ
- শ্রম অধিকার নিয়ে আরও কঠোর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
শ্রম অধিকার নিয়ে আরও কঠোর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ঢাকার দূতাবাসে যুক্ত হচ্ছেন পূর্ণকালীন শ্রম কর্মকর্তা

প্রতীকী ছবি
তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগে থেকেই বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে সরব যুক্তরাষ্ট্র। এ দুটি দুর্ঘটনার পর দেশটি মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বিশেষ শুল্ক্ক ছাড় সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে।
এবার বাংলাদেশে কর্মপরিবেশ, শ্রমমান ও অধিকার নিয়ে আরও কঠোর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শ্রম ইস্যুতে সরাসরি কাজ করার জন্য পূর্ণকালীন একজন শ্রম কর্মকর্তা যুক্ত হচ্ছেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে। কূটনৈতিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কূটনীতিক সমকালকে বলেন, ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে এতদিন কোনো শ্রম কর্মকর্তা ছিলেন না। এবার এক কর্মকর্তা যুক্ত হতে যাচ্ছেন। সেই কর্মকর্তা বাংলাদেশের শ্রম অধিকার, কাজের পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও বৈষম্য, শ্রমমানসহ সার্বিক বিষয়গুলো দেখভাল করবেন। শিগগিরই এ কর্মকর্তা ঢাকায় এসে দায়িত্ব বুঝে নেবেন।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডিএফসি তহবিল পেতে চায় ঢাকা। আর এর তহবিল পেতে বাংলাদেশকে ফেরত পেতে হবে জিএসপি সুবিধা। এ শ্রম কর্মকর্তার বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন জিএসপি ফেরাতে সহায়ক হবে।
সূত্র জানায়, প্রতিবছর বাংলাদেশের শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সংগঠনের স্বাধীনতা এবং দরকষাকষির অধিকার, জোর করে শিশুশ্রম, কর্মস্থলের নিরাপত্তা, পেশার ক্ষেত্রে বৈষম্য, শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, শ্রম ইউনিয়ন করার অধিকার, কর্মক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য শর্তাবলি, শ্রমিকের কর্মঘণ্টাসহ সার্বিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। বিষয়গুলোতে বেশ সমালোচনামুখর যুক্তরাষ্ট্র। দূতাবাসে নতুন কর্মকর্তা যোগ দিলে এ বিষয়গুলোতে দেশটি থেকে আরও কঠোর প্রতিবেদন আসতে পারে। জিএসপি পুনর্বহালের বদলে ২০২৬ সালের পর শ্রম ইস্যুতে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক্কহার কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন। তবে জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মার্কিন এ প্রতিবেদন আমলে নেয়। ফলে সার্বিক শ্রম অধিকারের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের মূল বাজারে চাপে পড়তে পারে ঢাকা।
নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, শ্রম অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। আর প্রতিবছরই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর যে মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশের শ্রম খাতের অধিকার নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। আর এ প্রতিবেদন এতদিন তৈরি করত ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকরা। এখন একজন শ্রম কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ায় শ্রম অধিকারের বিষয়গুলো আরও জোরালো পর্যালোচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, আসছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের বিষয়ে বেশ সমালোচনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বিষয়টিতে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এক রকম বার্তা দিয়েছে দেশটি। এবার শ্রম অধিকার নিয়ে সরব হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতের প্রকল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) যাত্রা শুরু করে। মার্কিন কংগ্রেস ডিএফসিকে বিভিন্ন দেশে ৬ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়। তবে কোনো দেশে অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেশটির পরিবেশ, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের উচ্চ মান নিশ্চিত করার বিষয়টি তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এ বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরামর্শক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ডিএফসির তহবিল সুবিধার জন্য ওয়াশিংটনের কাছে অনুরোধ করে ঢাকা। এ তহবিল পেতে বাংলাদেশকে শ্রমের মান উন্নয়নের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে দেশটি।
নাম প্রকাশ না করে আরেক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, শ্রমমান উন্নয়ন নিয়ে আইএলওর যে নির্দেশনাগুলো রয়েছে, তা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও উদ্বেগ রয়েছে। তবে তারা শ্রমমান উন্নয়নে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। এমনকি ২০৩০ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধা বাড়িয়েছে। তবে তাদের বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে জাতিসংঘের ৩৩টি সনদ মেনে চলার বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বিষয়ে একটু আগ্রাসীই দেখা যায়।
তবে কূটনীতিকদের কেউ কেউ মার্কিন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ ও মান নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময়ে বিষয়টি ঠিক আমলে নেয়নি বাংলাদেশ। তাজরীন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কিছুটা উন্নতি হয়েছে শ্রম পরিবেশ। এখন শ্রম কর্মকর্তা নিয়োগ হলে কিছুটা চাপে থাকবে ঢাকা।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের এক অনুষ্ঠানে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস প্রথমবারের মতো একজন পূর্ণকালীন বাণিজ্য কর্মকর্তা যুক্ত করার কথা জানান। এ সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে শ্রমমানের উন্নয়ন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের বিষয়টিও জানান তিনি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সর্বশেষ মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকলেও তা নিয়ে রয়েছে জটিলতা। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে করা হচ্ছে প্রত্যাখ্যান এবং এ প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন নিবন্ধক প্রায়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কারণ ছাড়াই আবেদন প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বকেয়া মজুরি ও বেতন বাড়ানো নিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলি, তাতে সাত শ্রমিক নিহত ও কয়েকজন আহতের উদাহরণ তুলে ধরা হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমের বিষয়টি আইন করে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে শিশুশ্রম চলছে জানিয়ে প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়।
বাংলাদেশের আইনে পেশার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শ্রম আইনে লিঙ্গ ও অক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে মজুরি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সরকার কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগ করেনি। এ ছাড়া মজুরি ও শ্রমঘণ্টা, পেশাগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মতো বিষয়গুলোতে প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়।
মন্তব্য করুন