ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জগতে আজকাল 'স্টার্টআপ' শব্দটি প্রায়ই শোনা যায়। বাজারে থাকা চাহিদার একটি উদ্ভাবনী সমাধান দেয় এমন নতুন উদ্যোগকে স্টার্টআপ বলা হয়। আগামীর বাংলাদেশে এই স্টার্টআপই হতে পারে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার অনেক বড় ক্ষেত্র। ইতোমধ্যে কিছু সাফল্যের উদহারণও তৈরি হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে স্টার্টআপে বিনিয়োগ হয়েছে আগের বছরের প্রায় ১০ গুণ। দেশে এখন এ ধরনের উদ্যোগের সংখ্যা ১২ শতাধিক। এসব প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করছে। আর স্টার্টআপের উদ্যোক্তা বেশিরভাগই তরুণ, যাঁদের ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশি স্টার্টআপদের মধ্যে চালডাল ডটকম, পাঠাও, শপআপ, সেবা, টেন মিনিট স্কুল, পেপারফ্লাই, ট্রাক লাগবে, শিউর ক্যাশ, সহজ, প্রাভা হেলথ, আই ফার্মার, শিখো ইত্যাদি পরিচিত। এমনকি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ-এর যাত্রা হয়েছিল স্টার্টআপ হিসেবেই। স্টার্টআপের হাত ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে অন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর।

ব্যবসা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসেল পার্টনারস সম্প্রতি 'বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ২০২১-২২' নামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে স্টার্টআপে ৪১৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের স্টার্টআপের মধ্য বেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে আর্থিক প্রযুক্তি বা ফিনটেক। এর মধ্যে বিকাশ ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এনেছে। আর্থিক প্রযুক্তি খাতের আরেক কোম্পানি খাত 'শপআপ' নিয়ে এসেছে আরও ৭৫ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া লজিস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ই-কমার্স প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগ আসছে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত স্টার্টআপে উৎসাহ জোগাচ্ছে। সরকারের আইসিটি বিভাগের ৫০০ কোটি টাকার একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড রয়েছে। প্রতিবছর এখান থেকে তহবিল পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান স্টার্টআপের জন্য সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে। গ্রামীণফোন 'জিপি এক্সেলারেটর' প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশের সেরা স্টার্টআপগুলোকে খুঁজে বের করে বিনিয়োগ পেতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা করা হয়। গ্রামীণফোন এক্সেলারেটরের ৭টি ব্যাচ ৫০টি স্টার্টআপ গ্র্যাজুয়েশন করেছে। এসব স্টার্টআপ সারাদেশে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। গ্রামীণফোন এক্সেলারেটর থেকে বের হয়ে স্টার্টআপগুলো এখন অনেক দূর এগিয়েছে।

গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমান সমকালকে বলেন, 'আমাদের তারুণ্যের অদম্য শক্তি আগামীতে বাংলাদেশের আরও উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে বলে আমি বিশ্বাস করি। নতুন উদ্ভাবন, আইডিয়া দিয়ে আমাদের তরুণরাই আগামীর সম্ভাবনা উন্মোচনে নেতৃত্ব দেবে। উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দিয়ে আমরা সামনের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্টম্ন বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ এখন ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশে অর্থনীতি হবে প্রযুক্তিভিত্তিক, যেখানে আজকের তরুণরা নেতৃত্ব দেবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে আমাদের তরুণরা ইতোমধ্যে স্টার্টআপ খাতে বিশ্ব জয় করতে শুরু করেছে। বড় বড় অনেক বিদেশি বিনিয়োগ পেতে শুরু করেছে আমাদের স্টার্টআপগুলো। এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে এবং স্টার্টআপগুলোর ইনোভেশন আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। অনেক তরুণের কাজের প্রথম পছন্দ হবে এসব স্টার্টআপ।

গ্রামীণফোনের সিইও আরও বলেন, সামনে যে বাংলাদেশ আসছে, তা আজকের বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে। নিজের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এখনই। গ্রামীণফোন আগামীর বাংলাদেশের তরুণদের পথনির্দেশনা দিতে একদিকে জিপি এক্সেলারেটর প্রোগ্রামের মাধ্যমে সহায়তা করছে; অন্যদিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ইউএনডিপির সঙ্গে অংশীদারিত্বে তরুণদের আগামীর বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হতে 'ফিউচার নেশন' প্রোগ্রাম চালু করেছে। তরুণদের ভাবনার উন্নয়ন ও বাস্তবে রূপ দিতে সবাই এগিয়ে এলে স্টার্টআপগুলোর উদ্যোগ জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

লাইটক্যাসল পার্টনার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্টার্টআপের সাফল্যের পেছনে মূল কয়েকটি কারণ রয়েছে। বেশিরভাগ স্টার্টআপ প্রযুক্তিনির্ভর। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। তরুণরা প্রযুক্তিপ্রেমী এবং তারা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়। দেশের মধ্যে প্রতি তিনজনের দুইজনের এখন এমএফএস হিসাব রয়েছে। দেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। জনসংখ্যার তরুণ এবং প্রযুক্তিপ্রেমীদের চাহিদা অনুযায়ীই বাজারে পণ্য আসছে। পণ্য ও সেবার চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তিত চাহিদা নিয়েই কাজ করছে স্টার্টআপ ব্যবসাগুলো।

বিশ্বে স্টার্টআপের সাফল্যের সবচেয়ে বড় উদহারণ সিঙ্গাপুর। মানুষের আয় বৃদ্ধি, ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ এবং নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য সিঙ্গাপুর স্টার্টআপের জন্য আকর্ষণীয়। সিঙ্গাপুরের স্টার্টআপ খাতে যে বিনিয়োগ আসে, তা জিডিপির ২৮ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্টার্টআপ উৎসাহিত হচ্ছে। তাদের এ খাতে বিনিয়োগ আসে জিডিপির দেড় শতাংশের মতো। বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে স্টার্টআপে বিনিয়োগ মাত্র শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। তবে আগামীতে এটি বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ স্টার্টআপ মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং তাদের ব্যবসা বাড়ছে। অনেকের সকাল শুরু হচ্ছে পাঠাও বা উবারের মাধ্যমে; বাজার করছেন চালডাল-এর মাধ্যমে; খাবার অর্ডার করছেন পাঠাও বা ফুডপান্ডা দিয়ে। আবার ডাক্তার দেখাচ্ছেন অনলাইনে কোনো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।

সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ :আইপেজ নামক স্টার্টআপের সূচনা হয়েছিল ২০১৯ সালের প্রথমদিকে। সুহৃদ, মিঠু ও নিসাত নামে তিন বন্ধু এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করেন, যা মাটির অবস্থাভেদে কোন কীটনাশক ব্যবহার করা ঠিক হবে, তা বলে দিতে পারে। আইপেজ ব্যবহারকারী কৃষকদের উৎপাদন খরচ ২০ শতাংশের মতো কমেছে। প্রজনন স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে নারীদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ওয়েলনেস প্ল্যাটফর্মের নাম 'লাইল্যাক'। নারীর ঋতুস্রাবকালীন বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় সাবস্ট্ক্রিপশনভিত্তিক পিরিয়ড কেয়ার সার্ভিস তৈরি করার মাধ্যমে ২০২১ সালে লাইল্যাকের যাত্রা শুরু। 'ওয়ানথ্রেড' একটি বাংলাদেশি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটি এজেন্সি, স্টার্টআপ এবং অনলাইন ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ কাজ পরিচালনা এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তৈরি। ওয়ানথ্রেড ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী তাদের পণ্যের প্রসার নিয়ে কাজ করছে। 'গেম অফ ইলেভেন' নামে স্টার্টআপ একটি ফ্যান্টাসি স্পোর্টস প্ল্যাটফর্ম। এটি সাধারণত অনলাইনে খেলা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি গ্লোবাল ফ্যান্টাসি স্পোর্টস ব্যবহারকারী রয়েছেন। বিশ্ববাজারের গ্রাহকদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা তৈরি করে স্টার্টআপটি অদূর ভবিষ্যতে দেশের বাইরে বাজার পাওয়ার প্রত্যাশা করছে।