- বাংলাদেশ
- দালাল ছাড়া সনদ মেলে না, পদে পদে ভোগান্তি
দালাল ছাড়া সনদ মেলে না, পদে পদে ভোগান্তি
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস আজ

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের রিয়াজ উদ্দিন অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করতে কয়েক দিন ধরেই করছেন নানা কসরত। পাসপোর্ট করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সার্ভার থেকে তাঁর জন্মনিবন্ধনের তথ্য হাওয়া হয়ে গেছে। নতুন করে নিবন্ধন করতে গিয়ে পড়েন ফ্যাসাদে। কোনোভাবেই ঢুকতে পারছিলেন না সার্ভারে। অগত্যা ছোটেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অঞ্চল-২ অফিসে। সেখানকার কর্মকর্তারা তাঁকে জানান, অনলাইনে আবেদনের পর কাগজপত্র জমা দিলেই জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হবে। আগে হাতে লিখে দেওয়ার পদ্ধতি থাকলেও এখন পুরোটাই অনলাইনে। তবে রিয়াজ উদ্দিন সার্ভারে ঢুকতে না পারায় অনলাইনে আবেদনও করতে পারছেন না। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধন শিশুর মৌলিক অধিকার। যদি মৌলিক অধিকারই হয়, তাহলে এতটা ভোগান্তি কেন? অনেক সময় জন্মনিবন্ধনের জন্য গুনতে হয় ঘুষ।
জন্মনিবন্ধনের এই পেরেশানি রিয়াজ উদ্দিনের একার নয়। সাধারণ নাগরিকদের এ ভোগান্তি পদে পদে। আবেদন থেকে শুরু করে সনদ পাওয়া পর্যন্ত বিপত্তি লেগেই থাকে। আবার আবেদনের পরও ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে সনদ পেতে লাগছে ৩ থেকে ৬ মাস। এতে জড়িত দালালচক্র। ফলে জন্মসনদের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও ভোগান্তির একই চিত্র।
এই প্রেক্ষাপটে প্রতিবছরের মতো এবারও সারাদেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস পালন করা হবে আজ। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীসহ সারাদেশে হবে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা।
জানা যায়, দেশে জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে এ কাজ বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি। ভুল সংশোধনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে যেতে হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী প্রত্যেক শিশুরই জন্মের পর নিবন্ধন করার কথা বলা আছে। দেশের জাতীয় শিশুনীতি ২০১১-এর অনুচ্ছেদ ৬-এ সব শিশুর জন্মনিবন্ধন নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জন্মসনদের ফি ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা হলেও একটি সনদ পেতে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। কম্পিউটার কম্পোজের দোকানগুলোর লোকজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়। অথচ এর আগে অ্যানালগ পদ্ধতিতে সহজেই সনদ সংগ্রহ করা যেত।
কয়েকটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সবখানেই সিন্ডিকেট। জন্মনিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়া দালালদের খপ্পরে। কর্মীদের অধিকাংশই অদক্ষ। এতে ভোগান্তি আরও বেশি হচ্ছে।
সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণের জন্য ছেলেমেয়ের পাসপোর্ট আবেদন করতে যান রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার রিফাত হোসেন। কাগজপত্রের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন সনদও জমা দেন তিনি। তবে পাসপোর্ট অফিস থেকে জানানো হয়, ছেলেমেয়ের জন্মনিবন্ধন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে তিনি সিটি করপোরেশনে এটি ঠিক করতে গেলে তাঁকে অনলাইনে আবার আবেদন করতে বলা হয়। পরে দেখা যায়, সার্ভার কাজ করে না। কম্পিউটারের দোকানে দিতে হয় ২০০ টাকা। তাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সংযোগ আছে। ২ হাজার টাকা দিলে কম সময়ের মধ্যেই সনদ পাওয়া যায়।
অনলাইনে আবেদনের পর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন আগারগাঁও এলাকার পারেভেজ। দেড় মাসের বেশি সময় ঘুরে জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রায় তিন মাস ঘুরে তাঁর নিজেরসহ ছেলেমেয়ের জন্মসনদ হাতে পান। রাজধানীর উত্তরায় সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে যান সজীব মিয়া। তাঁর কাছে ২ হাজার টাকা দাবি করা হয়। দেড় মাস পরও নিবন্ধন হাতে পাননি। মোহাম্মদপুরের রহিমা বেগম একই রকম ভুক্তভোগী।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, অনলাইনে সার্ভার ডাউনের বিষয়টি এর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় এবং সব সিটি করপোরেশনের বৈঠকে তোলা হলেও দীর্ঘদিনেও সমাধান হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর রেজিস্ট্রেশন সহকারী গিয়াসউদ্দিন সমকালকে বলেন, নিবন্ধনের সার্ভার অধিকাংশ সময়ই ডাউন থাকে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, কয়েক দিন ধরে অঞ্চল-৪ অফিসে কোনোভাবেই সার্ভারে ঢোকা যাচ্ছে না। তবে এখন আর শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্মসনদ লাগে না।
হারানো তথ্য উদ্ধার হয়নি :জন্ম ও মৃত্যনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের পুরোনো সফটওয়্যার থেকে নতুন সফটওয়্যার চালু করার সময় প্রায় পাঁচ কোটি জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যায়। সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে দেশে জন্মনিবন্ধন আইন কার্যকর হয়। পাসপোর্ট ইস্যু, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। ২০১০ সালের শেষদিকে জন্মনিবন্ধন ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত নিবন্ধকের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য সরকার আলাদা বরাদ্দ দেয়। সে সময় সব তথ্য ডিজিটাল করা হয়নি। ২০১০ সালের পর যে সার্ভারে কাজ করা হতো, তা বছরখানেক আগে পাল্টানো হয়। নতুন এ সার্ভারে আগের সার্ভারের তথ্য আর স্থানান্তর করা হয়নি। ফলে আগের সার্ভারের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যায়।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সে সময় গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পুরোনো নিবন্ধিতদের জন্মনিবন্ধন সনদ নতুন ওয়েবসাইটে যুক্ত করে নেওয়ার কথা বলা হলেও তা অধিকাংশ মানুষের অগোচরে থেকে যায়। ফলে এ আহ্বানে খুব বেশি সাড়া মেলেনি। কর্মকর্তারা বলেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের তথ্যগুলো অনলাইনে আপলোড করার সুযোগ ছিল। এর পর নতুন সার্ভার আসে। তবে সেটিতে পুরোনো তথ্য আপলোড করার সুযোগ না থাকায় ২০১১ সালের আগে করা বহু নিবন্ধন স্বয়ংক্রিয়ভাবে হারিয়ে যায়। এখন আবার নতুন সার্ভারে পুরোনো তথ্য স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। ফলে যাদেরটা বাদ পড়েছে, তাদের নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন মোবারক বলেন, নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে প্রতিদিন অনেক লোক আসছেন। তাঁদেরকে নতুন করে ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, সার্ভার সব সময় ডাউন থাকার বিষয়টি সত্য নয়। তবে সার্ভার উন্নয়নের কাজ চলছে। আর পুরোনা জন্মনিবন্ধনকারীদের তথ্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নতুন ওয়েবসাইটে যুক্ত করতে বলা হয়েছিল। যাঁরা করেননি, তাঁদের নতুন করে জন্মসনদ নিতে হবে।
মন্তব্য করুন