- বাংলাদেশ
- রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়নি সংবিধান দিবস
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়নি সংবিধান দিবস

ছবি: ফাইল
সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- 'ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের আখরে লেখা' সংবিধান গণপরিষদে গ্রহণ হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। প্রতিবছর বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করলেও সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এবার সংবিধানের ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে, সুবর্ণজয়ন্তীতেও সংবিধান দিবস পালনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই।
জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চেতনা জাগ্রত রাখতে এবং অনাগত প্রজন্মের কাছে সংবিধান লালন ও বিকাশে দিনটি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজন। তাঁরা বলছেন, যে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সংবিধান পেয়েছে, সেই দলটি টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। তবু সংবিধান দিবস রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পাওয়াটা আক্ষেপের।
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, 'সংবিধান দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। শিগগির এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।' গেল কয়েক বছর সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তবে স্বীকৃতির উদ্যোগ দৃশ্যমান নয় কেন, উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, 'আরেকটু অপেক্ষা করেন, দেখেন, আশা করি ইতিবাচক কিছু দেখতে পাবেন'।
জাতীয় দিবসগুলো নির্ধারণ করে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী তিন ভাগে ৮৫টি জাতীয় দিবস পালন হয়। 'ক' শ্রেণির দিবস ১৮টি, 'খ' শ্রেণির দিবস ৩৪টি এবং 'গ' শ্রেণির দিবস আছে ৩৩টি। সাধারণত 'ক' শ্রেণির দিবসগুলোতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অংশ নেন। 'খ' ও 'গ' শ্রেণির দিবসগুলোতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান হয়।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জনের মধ্যে চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেনসহ তিন সদস্য বেঁচে আছেন। অন্য দু'জন হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। এদের তিনজনই সংবিধানে খসড়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ সমকালকে বলেন, 'পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান রচনা করেও সেটি মানুষের কাছে গুরুত্ব দিয়ে পৌঁছানো যায়নি। এটা আমাদের জাতিগত অবমাননা।' তিনি বলেন, 'বহু দেশে সব স্তরের শিক্ষায় বিভিন্ন মাত্রায় সংবিধানকে জানার সুযোগ রাখা হয়। যাতে তরুণরা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি রাষ্ট্র গঠন, পরিচালনা ও রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পেতে পারে। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটা নেই।'
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, 'সংবিধান দিবসের স্বীকৃতি এবং সেটা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালন করা উচিত। '৭২-এর সংবিধান তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। ১৯৯৯ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জনের মধ্যে জীবিত থাকা ১৯ জনকে আমরা সম্মাননা জানিয়ে বড় অনুষ্ঠান করেছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ এই দলিলটি তৈরিতে যাঁরা অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদেরও কোনো সরকার আলাদা সম্মান জানায়নি। এটা আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। দুর্ভাগ্য, সব সরকারই মুখে আইনের শাসনের কথা বলে কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সংবিধানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা বোঝেন না।'
সংবিধান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট আরিফ খান বলেন, 'ফরাসি বিপ্লব থেকে এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বের ৩সব সংবিধানের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, বিশ্বের অধিকাংশই সংবিধান গড়ে ১৭ বছরের বেশি টেকেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের রচিত কোনো সংবিধানের ৫০ বছর টিকে থাকা বৈশ্বিকভাবেই একটি বিশাল ঘটনা।
১৯৭২ সালের সংবিধানকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। সংবিধান দিবস সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কিছু বিচ্যুতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধান বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উদাহরণ। সংবিধান প্রণয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা যে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন তা প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে সংবিধানকে বেশি বেশি করে জানার-বোঝার ব্যবস্থা করতে হবে।'
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, 'পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংবিধান অর্জন করতে এত রক্তের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সংবিধানকে সম্মান জানিয়ে একটি দিন পালন করা হয় না।'
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, 'সংবিধান দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা উচিত।'
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, 'এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এভাবে অবহেলিত থাকা উচিত নয়।'
সংবিধান দিবসের বিষয়ে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকেও কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানা গেছে। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে পাশের দেশ ভারতে স্বাধীনতা দিবসের চেয়েও বেশি আড়ম্বর নিয়ে সংবিধান দিবস পালন করা হয়। ভারতে সংবিধান দিবস পালন হয় 'প্রজাতন্ত্র দিবস' হিসেবে। সমকালের নয়াদিল্লি প্রতিনিধি গৌতম লাহিড়ী জানিয়েছেন, ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস হলেও আড়ম্বরের দিক থেকে প্রজাতন্ত্র দিবস বেশি জাঁকজমপূর্ণ হয়। এদিন রাজপথে তিন বাহিনীর সমন্বয়ে সুসজ্জিত কুচকাওয়াজ হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এদিন ভারতের স্ব স্ব রাজ্য তাদের ঐতিহ্যবাহী বিষয়গুলো প্রদর্শন করে।
মন্তব্য করুন