- বাংলাদেশ
- অভিযান কম, সুযোগ নিচ্ছেন জেলেরা
অভিযান কম, সুযোগ নিচ্ছেন জেলেরা

প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ইলিশ নিধন। শুক্রবার বিকেলে দৌলতদিয়া চর কর্নেশন এলাকায়
ইলিশের নিরাপদ প্রজননের জন্য ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞার এক সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়েও গেছে। তবে অসাধু জেলেদের তৎপরতা থেমে নেই। সুযোগ পেলেই নদনদীতে জাল ফেলে ইলিশ শিকারে মেতে উঠছেন। মৎস্য বিভাগ কিংবা নৌ-পুলিশ অভিযান পরিচালনা করলেও তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।
গতকাল শনিবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে জেলের সংঘবদ্ধ দলকে ইলিশ শিকার করতে দেখা যায়। সিডারচর বালুরচর এলাকায় শতাধিক নৌকা দিয়ে দিনরাতে ইলিশ নিধন চলছে। উপজেলার শামুরবাড়ি গ্রামে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে বসে এসব ইলিশ বিক্রির হাট। এ চিত্র প্রতিদিনের বলে দাবি স্থানীয়দের।
শুক্রবার মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহাবুবুল হকের নেতৃত্বে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার পদ্মায় বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় নদীতে জাল কম থাকলেও প্রকাশ্যে স্পিডবোট ও ট্রলার নিয়ে পদ্মায় জাল ফেলতে দেখা গেছে। অনেকে ধাওয়া খেয়ে জাল রেখে পালিয়েছেন।
দিনে প্রশাসনের তৎপরতা থাকলেও রাতে নদী অরক্ষিত থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইলিশ নিধনে মেতে উঠেছেন জেলেরা। জেলা সদরের আধারা ইউপির চরআবদুল্লাহ, কালীরচর ও বকচর গ্রামসংলগ্ন মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরা থামছে না। সদরের চরআবদুল্লাহ, বকচর, কালীরচর গ্রামঘেঁষা মেঘনায় ইলিশ ধরায় ২০০ জেলে সক্রিয়।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল বলেন, হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশ থেকে এবং নৌপথ ও স্থলপথে একযোগে অভিযানের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শরীয়তপুর এলাকায় পদ্মা থেকে বিপুল পরিমাণ মা ইলিশ নিধনের বিষয়টি নিয়ে ওপর মহলেও আলোচনা চলছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বলেন, কিছু অসাধু জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছেন। ইলিশ ধরার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় ১ হাজার ১৪৯ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। এ উপজেলায় পদ্মার প্রায় ৪০ কিলোমিটার ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ। এ সময়ে জেলেদের চাল দিয়ে সহযোগিতা করছে সরকার।
শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার রাওথা, পিরোজপুর, গোপালপুর, মুক্তারপুর, ইউসুফপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক জেলে নৌকায় জাল নিয়ে মা ইলিশ শিকার করছেন। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নদীতে প্রশাসনের টহল ছিল না। সকাল ১০টার দিকে মৎস্য অফিস ও নৌ-পুলিশের সমন্বিত টহল দল অভিযানে নামলে জেলেরা তীরে নৌকা রেখে পালিয়ে যান। এক ঘণ্টা অবস্থান করে মৎস্য বিভাগের লোকজন চলে যান। এর পরেই জেলেরা ফের নদীতে ইলিশ ধরতে নেমে পড়েন। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত নদীতে জেলেদের মাছ শিকার করতে দেখা গেলেও কোনো টহল দল দেখা যায়নি।
স্থানীয় এক জেলের দাবি, এবার নদীতে প্রশাসনের তেমন দৌড়ঝাঁপ নেই। সারাদিন দু-একবার নদীতে আসেন প্রশাসনের লোকজন। প্রশাসনের কেউ কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অভিযানের তথ্য ফোনে জেলেদের জানিয়ে দিচ্ছেন।
উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিদিনই নদীতে অভিযান হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চারঘাট নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বেলাল হোসেন। তিনি দাবি করেন, জেলেদের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ৪০ কিলোমিটার নদী এলাকা দেখভালের জন্য নৌ-পুলিশের পর্যাপ্ত জনবল কিংবা স্পিডবোট নেই।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালিউল্লাহ মোল্লাহ বলেন, তিনি জেলা পরিষদের নির্বাচনের দায়িত্ব আছেন, সে জন্য প্রশিক্ষণে আছেন। তবে তাঁর অফিস থেকে অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।
পটুয়াখালীর দুমকির পাংগাশিয়া, আঙ্গারিয়া, লেবুখালী ও মুরাদিয়া ইউনিয়ন বেষ্টিত পায়রা, পাতাবুনিয়া ও লোহালিয়া নদীর অন্তত ১১টি এলাকায় দিনরাতে ইলিশ শিকার করছেন।
জানা যায়, স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়ায় জেলেরা তাঁদের শিশু-কিশোর সন্তানদের দিয়ে ইলিশ শিকার করছেন। প্রতিটি জেলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নৌকা-জাল নিয়ে নদীতে যাচ্ছেন। নারী, শিশু-যুবক সবাই নির্ঘুম পাহারায় রাত কাটান নদীতীরে। দূরে অভিযানের ট্রলার দেখলেই ফোনে জেলেদের জানিয়ে দেন তাঁরা। সংকেত পাওয়া মাত্রই দ্রুত নৌকা-জাল নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সটকে পড়েন জেলেরা।
স্থানীয়দের দাবি, ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়লেও তা বাজারজাত হচ্ছে না। হাজিরহাট, লেবুখালী ফেরিঘাট, ভাঙ্গার মাথা, আঙ্গারিয়া বন্দর, পাতাবুনিয়ার হাট, জেলেপাড়া, কদমতলা বাজার, উত্তর মুরাদিয়াসহ অন্তত ১১টি মাছঘাট এলাকায় পাইকারদের গোপন আস্তানায় ইলিশ মজুত রাখা হচ্ছে।
আঙ্গারিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ গোলাম মর্তুজার ভাষ্য, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে এ বছর ঠেকানো যাচ্ছে না শিকার। গত বছরে ব্যাপক প্রচারাভিযান হয়েছে। উপজেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে জেলেদের উপস্থিতিতে সভা করে ইলিশ রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। তা শতভাগ সফলও হয়েছে। তবে দেরিতে হলেও উপজেলার মাসিক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়নি বলে স্বীকার করেছেন উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিগগিরই চাল বিতরণ করা হবে। জনবল ও দ্রুতযান সংকটে অভিযান পরিচালনা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। সীমিত শক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নদীতে তেমন একটা নৌকা-জাল নেই বলে দাবি করেছেন ইউএনও মো. আল-ইমরান। তিনি বলেন, ইলিশ শিকার হচ্ছে না এমনটি নয়, তবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
শুক্রবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পদ্মার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া বাহির চর, চর কর্ণেশন কলাবাগান এলাকায় দেখা যায়, অনেক জেলে নৌকা নিয়ে নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করছেন। মৌসুমি জেলেও নেমেছেন। জেলেরা চর কর্ণেশন এলাকার দুর্গম কলাবাগানে ইলিশ বিক্রি করছেন।
দৌলতদিয়া আক্কাছ আলী হাই স্কুলের সড়ক ও বাহির চর দৌলতদিয়া ছাত্তার মেম্বার পাড়া এলাকা থেকে প্রশাসনের অভিযান দেখলেই সোর্স ফোনে জেলেদের জানিয়ে দেন।
শনিবার তিন জেলেকে কারাদণ্ড ও এক জেলেকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করার তথ্য জানিয়েছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহারিয়ার জামান সাবু। তিনি বলেন, ইলিশ শিকার বন্ধে তাঁরা নিয়মিত পদ্মায় অভিযান পরিচালনা করছেন। পদ্মাপাড়ের কয়েকটি স্থানে ইলিশ শিকার করে বিক্রির খবর শুনেছেন।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ১১ হাজার ৫৭৪ জেলের মধ্যে ১১ হাজার এবং রামগতি উপজেলার ২০ হাজার ৭০০ জেলের মধ্যে ১৭ হাজার ১৭ জনকে ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এ চাল এখনও পাননি জেলেরা।
জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁরা নদীতে মাছ শিকারে নামতে পারছেন না। এতে অনেক জেলে পরিবার খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছে। নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও তাঁরা তা পাননি।
সরকারের সহায়তার চাল পাননি বলে দাবি করেছেন উপজেলার চরফলকন এলাকার জেলে কামাল হোসেন। তিনি বলেন, মাছ শিকার বন্ধ হলেও বিকল্প আয় না থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
কমলনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল কুদ্দুস বলেন, ইতোমধ্যে একটি ইউনিয়নে জেলেদের মাঝে চাল বিতরণের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই চাল বিতরণ শেষ হবে। রামগতি উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, শিগগিরই প্রকৃত জেলেদের মাঝে চাল বিতরণ করা হবে।
ভোলা সদর ও বোরহানউদ্দিনের মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে অভিযান চালিয়ে ৩৫ জেলেকে আটক করা হয়েছে। এঁদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
বাউফলে তেঁতুলিয়া নদীতে ইলিশ শিকারের অভিযোগে আটক ২০ জেলের মধ্যে ১০ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য ১০ জেলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
দোহার উপজেলায় ১০ জেলেকে আটকের পর ১৪ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার সংবাদদাতা ও প্রতিনিধিরা।
মন্তব্য করুন