বাসটি ভাঙাচোরা, জরাজীর্ণ। খুলে পড়া পেছনের অংশ শিকলে আটকানো। খালি চোখেই ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০৯৮৫ নম্বরের এই বাসটির অবস্থা দেখা যায় সঙ্গিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এটিকেই গত বছরের ১০ মার্চ ফিটনেস সনদ দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফিটনেসের মেয়াদ রয়েছে আগামী ৯ মার্চ পর্যন্ত। শুধু গাজীপুর-রামপুরা (এ/৪৩৬) রুটের এই বাসটি নয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এমন অসংখ্য গাড়ি রয়েছে, যেগুলো জরাজীর্ণ হলেও কাগজে-কলমে ফিট। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সনদের জোরে সড়ক দাপিয়ে চলছে, ঘটছে দুর্ঘটনা।

গত সোম ও মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন রুটের ২০টি ভাঙাচোরা বাসের ছবি তুলেছে সমকাল। এগুলোর ফিটনেস, নিবন্ধন হালনাগাদ আছে কিনা তা যাচাইয়ে দৈবচয়নের ভিত্তিতে পাঁচটি বাসের তথ্য বিআরটিএ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বিস্ময়কর তথ্য, সবক'টির ফিটনেসসহ সব কাগজ হালনাগাদ আছে। পথে চলতে, যাত্রী পরিবহনে বাধা নেই। যতই ভাঙাচোরা হোক, বিআরটিএ কিংবা পুলিশ কিছুই করতে পারবে না।

ভাড়া বাড়াতে পরিবহন মালিকরা গত আগস্টে হিসাব দেন, ঢাকার বাসে বিনিয়োগ, মবিল, যন্ত্রাংশ, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, বেতনসহ বছরে ব্যয় ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৮৪৮ টাকা। প্রতি পাঁচ বছরে একবার রেনোভেশনে (পুনর্নির্মাণ) সাড়ে ৬ লাখ টাকা খরচ।

ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০৯৮৫ নম্বরের বাসটির উৎপাদন সাল ২০১৬। রক্ষণাবেক্ষণে এত খরচ করেও মাত্র ছয় বছরে বাসটি কীভাবে ভেঙেচুরে গেছে? এর জবাব পরিবহন মালিকদের সূত্রেই পাওয়া গেছে। তাঁদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ট্রাক, বাসসহ অধিকাংশ বাণিজ্যিক গাড়ির ইঞ্জিন ও মূল কাঠামো (চেসিস) বিদেশ থেকে আমদানি হলেও বডি তৈরি হয় দেশে। খরচ বাঁচাতে সড়ক পরিবহন আইনের কারিগরি বিনির্দেশ মানা হয় না। রক্ষণাবেক্ষণও হয় না। কিন্তু তাতে ফিটনেস পাওয়া আটকায় না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, একটি বাস ছয় বছরে ভেঙেচুরে যেতে পারে না। এর অর্থ কারিগরি বিনির্দেশ মেনে বডি তৈরি হয়নি। ফলে বাসে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা, তা নেই। এতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে। নির্ধারিত মানের কাঠামো ও বডি তৈরি না হওয়ায় সামান্য দুর্ঘটনায় বাস দুমড়েমুচড়ে যাত্রী মরে।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ সমকালকে বলেছেন, একাধিক দুর্ঘটনার তদন্তে পেয়েছেন, ফিটনেস সনদ থাকলেও গাড়িটি আদতে ফিট বা চলাচলের উপযোগী ছিল না। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল ভঙ্গুর। তাই গাছ বা অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কায় যাত্রীর প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি।

গ্রিন আনাবিল পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৬৮৯৩ নম্বরের বাসটি ২০১৯ সালে নির্মিত। এ বাসটিও ইকুরিয়া সার্কেল থেকে গত বছরের ২৪ মে ফিটনেস সনদ পেয়েছে। আগামী ২৩ মে পর্যন্ত ফিটনেসের মেয়াদ রয়েছে। অথচ সরেজমিন দেখা গেছে, বাসটির সামনের কাচ ভেঙেচুরে গেছে। বাসের একটি সংকেত বাতিও ঠিক নেই। পুরো বডি রংচটা এবং অন্য বাসের ঘষায় জরাজীর্ণ। বাসের পেছনের বাঁ পাশের অংশ খসে পড়েছে। বাইরে থেকে বাসের যাত্রীর পা দেখা যায়!

বলাকা পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-২৬৯০ নম্বরের বাসটির পুরো বডিতে মরিচা ধরেছে। সামনের কাচ ভাঙাচোরা। বডির জোড়াগুলোও খুলে পড়ছে। এ বাসটি গত ৬ জুন ইকুরিয়া সার্কেল থেকে ফিটনেস সনদ পেয়েছে। ২০১৬ সালে নির্মিত ভিক্টর পরিবহনের ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৯৩০৯ নম্বরের বাসটিরও একই দশা হলেও গত ২৮ জুলাই মিরপুর সার্কেল থেকে ফিটনেস সনদ পেয়েছে।

সমকাল যে পাঁচটি বাসের তথ্য পেয়েছে, এর তিনটির মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের দাবি, নিয়ম মেনে ফিটনেস পেয়েছেন। নিয়ম মানলে বিআরটিএ ভাঙাচোরা বাসকে কী করে সনদ দিল- প্রশ্নে গিয়াসউদ্দিন নামে একজন মালিক বলেছেন, 'আগে তো গাড়ি না নিলেও চলত। এখন গাড়ি নিয়ে লাইন ধরে ফিটনেস লই। বিআরটিএ দেয় কেন? তাগো জিগান। তারা তো গাড়ি ভালো থাকলেও ফিটনেস দিতে চায় না, মাল (টাকা) না দিলে।'

বিআরটিএর ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সমকালকে বলেছেন, গাড়ির প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মিরপুর সবচেয়ে বড় সার্কেল। কিন্তু গাড়ি রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। মোটরযান পরিদর্শকদের রাস্তায় গিয়ে গাড়ি দেখতে হয়। বেশি সময় নিয়ে দেখলে পুরো সড়কে যানজট হয়ে যায়।

সক্ষমতা বাড়াতে তিন হাজার ২০০ নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছিল বিআরটিএ। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ৯৬টি পদ সৃষ্টির অনুমোদন দিয়েছে। সারাদেশে বিআরটিএর জনবল ৯১৯ জন। মোটরযান পরিদর্শক ও সহকারী পরিদর্শক পদ রয়েছে ৪০০। তাদের দিয়ে ৩৮ লাখ ৯০ হাজার মোটরসাইকেল বাদে ১৫ লাখ ৭০ হাজার গাড়ির ফিটনেস দিতে হয়।

মিরপুরে ১৯ জন মোটরযান পরিদর্শক রয়েছেন। ১০ জন ফিটনেস যাচাই করেন। ৭ সহকারী পরিদর্শক সহায়তা করেন। গড়ে প্রতিদিন হাজারখানেক গাড়ি মিরপুরে আসে ফিটনেস নিতে। ১০ জন পরিদর্শককে সাত ঘণ্টায় ১০০ করে গাড়ি দেখতে হয়। ফিটনেস দিতে ৬০ ধরনের কারিগরি ও যানের বাহ্যিক দিক দেখতে হয়। এতে ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা। কিন্তু এক মিনিটেরও কম সময় পান পরিদর্শকরা। বাকি সময় যায় গাড়ির কাগজ যাচাইয়ে।

পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা সমকালকে বলেছেন, কিছু যাচাই না করেই সনদ দেওয়া হয়। একাধিক বাস ও ট্রাক মালিক সমকালকে বলেছেন, ঘুষ না দিলে গাড়ি ঠিক থাকলেও ফিটনেস মেলে না। টাকা দিলে বছরের পর সনদ পাওয়া যায়। গত ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশালে যে ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো ট-২০-৩৫৮০) চাপায় মায়ের পেট ফেটে সড়কে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সেই গাড়ি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ফিটনেস সনদ দেওয়ার নজিরবিহীন দুর্নীতিও হয়েছে।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সমকালকে বলেছেন, মানুষের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রাইভেট কার মোটিমুটি ভালোই থাকে। বাস, ট্রাকসহ বাণিজ্যিক গাড়ি ভালোভাবে খতিয়ে ফিটনেস দিতে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে অনেক কথা হয়। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, গাড়ির অবস্থা যেমনই হোক, ফিটনেস পেতে সমস্যা নেই। এই ফিটনেস থাকলেই কি, না থাকলেই কি।

বাস যেমন-তেমন, ঢাকার প্রান্তসীমানায় হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, চিটাগং রোড, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, ধনিয়া এলাকায় যে হিউম্যান হলার, লেগুনা চলে, সেগুলোর কোনো কিছুই নেই। শনির আখড়ায় একটি হিউম্যান হলারের (ঢাকা মেট্রো-ছ-১১-১৫৪২) পুরো বডি ভাঙাচোরা। গাড়ির সামনের কাচ, পাশের আয়না, সংকেত বাতি, কিছুই নেই। কিন্তু পথে চলছে দাপিয়ে।

২০২০ সালে সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, সারাদেশে চার লাখ ৮১ হাজার গাড়ি ফিটনেসবিহীন। বর্তমানে এ সংখ্যাটি কত, তা জানাতে পারেনি বিআরটিএ। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, সাড়ে পাঁচ লাখ গাড়ি ফিটনেসবিহীন। তবে যে ১০ লাখ গাড়ির ফিটনেস সনদ রয়েছে, সেগুলো কতটা যাচাইবাছাই করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফিট ঘোষণা করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকের মতো প্রায় ৪০ লাখ অবৈধ যানবাহন রয়েছে, সেগুলো ফিটনেসের আওতাতেই নেই। ২০১৮ সালে হাইকোর্টে দেওয়া জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিনটেস সনদ পাওয়া ৮৩টি গাড়ির ২৪ শতাংশই ছিল আনফিট।