- বাংলাদেশ
- দুর্ঘটনায় পঙ্গু হাজারো পরিবারে কান্না
দুর্ঘটনায় পঙ্গু হাজারো পরিবারে কান্না

কুমিল্লার লাকসামের আবুল কালাম আজাদ গাড়ির টায়ার মেরামত করতেন। গত সোমবার সন্ধ্যায় নিজ দোকানের সামনে কাভার্ডভ্যানের চাপায় তাঁর ডান পা থেঁতলে যায়। ভাঙা হাড় নিয়ে লাকসামের ক্লিনিক ঘুরে তাঁর ঠিকানা এখন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পঙ্গু হাসপাতালের নিচতলার বারান্দা।
গত বুধবার সেখানে তাঁর ছোট ভাই শামীমুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, কাভার্ডভ্যান মালিক ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। অথচ অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আসতেই ভাড়া লেগেছে ১৫ হাজার টাকা। তিন দিনে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবুল কালাম তিন ও শামীমুল দুই সন্তানের বাবা। দুই ভাই হাসপাতালে থাকায় দোকান ও রোজগার বন্ধ।
শামীমুল জানান, আবুল কালামের পায়ে এক দফা অস্ত্রোপচার করে প্লেট, নাট-বোল্ট বসানো হয়েছে। আরও দু'বার অপারেশন করতে হবে। পরীক্ষা, ড্রেসিং, অপারেশন সবকিছুতে প্রচুর টাকা লাগছে। সামনে দিনগুলোতে কীভাবে পরিবার চলবে, কোথা থেকে চিকিৎসা খরচ আসবে- ভেবে পাচ্ছেন না। ক্ষতিপূরণ পাবেন- এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। শুধু আবুল কালাম নন, সড়কে হতাহত প্রায় প্রতিটি পরিবারের
একই দশা। নিহতদের পরিবার পড়ে অথৈ সাগরে। পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত রাজধানীর নিটোর হাসপাতালে গত মঙ্গল ও বুধবার ঘুরে এমন বহু মানুষের দেখা পাওয়া যায়; দুর্ঘটনার শিকার পঙ্গু স্বজনের চিকিৎসা করাতে যাঁরা আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
এ রূঢ় বাস্তবতায় আজ শনিবার পালিত হবে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য 'আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি'। দুর্ঘটনা রোধে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে সড়কে আইন মেনে চলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্র জানায়, ১৭ অক্টোবর আসা ২১৩ রোগীর ২৯ জনই ছিলেন দুর্ঘটনার শিকার; এর মধ্যে ২৬ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত। ১৮ অক্টোবর আসা ২০৮ জনের মধ্যে ৪৩ জনই সড়কে আহত হয়েছেন।
হাসপাতালে বুধবার বিকেল ৪টায় কাজল নামে এক তরুণকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে ধরাধরি করে নামানো হয়। তাঁর বাঁ পা ঊরু থেকে নেই। স্বজনরা জানান, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এ অবস্থা। সঙ্গে ছিলেন কাজলের তরুণী স্ত্রী। তিনি নীরবে কাঁদছিলেন। আত্মীয় কাওসার হোসেন জানান, শ্যালো ইঞ্জিনে তৈরি 'আলম সাধু'র চাপায় পা গেছে কাজলের। বিদেশ যেতে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। পা হারানোয় আর যাওয়া হবে না। তাঁর পুরো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেল।
দেশে এমন হাজারো পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু ও অঙ্গহানিতে পঙ্গু হয়ে গেছে। সড়ক পরিবহন আইনের ৫২ ধারা অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় উত্তরাধিকারীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। ৫৩ ধারায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। তিন বছর আগে আইন কার্যকর হলেও বিধিমালা না হওয়ায় তহবিল গঠন হয়নি। সড়কে নিয়ম ভঙ্গে জেল-জরিমানা বহু গুণ বাড়িয়ে করা এ আইনে কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। ক্ষতিপূরণ এখনও পরিবহন মালিকের ইচ্ছা ও সামাজিক সালিশের ওপর নির্ভর করে।
দুই বছর আগেও স্বামী শহিদুল ইসলাম ও চার মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল কুষ্টিয়ার খোকসার কমলাপুর গ্রামের রেহেনা বেগমের। ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ী শহিদুলের সচ্ছলতা ছিল। দান করার খ্যাতি ছিল তাঁর। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় মোটরসাইকেলে থাকা শহিদুলের মৃত্যু হয় সাত দিন হাসপাতালে থাকার পর। বড় মেয়ে সাদিয়া পারভীনকে বিয়ে দিয়ে গেছেন। অন্য তিন মেয়ে- মৃত্তিকা স্নাতক, সিনথিয়া এসএসসি ও রাকা ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। শহিদুলের ব্যবসাই ছিল পরিবারের আয়ের উৎস। তাঁর মৃত্যুর পর রেহেনা জানতে পারেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২৭ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। মহাজনরাও পাওনা দাবি করছেন। সব মিলিয়ে কোটি টাকা দেনার দায় রেহেনার কাঁধে। টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিন মেয়ে নিয়ে টিনশেড ঘরে থাকেন রেহেনা। বারান্দায় সেলাইয়ের কাজ করেন তিনি ও মেয়েরা। তাই দিয়ে চলে সংসার। রেহেনা বলেন, 'চাল, আটা, তেলসহ সবকিছুর দাম চড়া। মাছ-মাংস কেনা হয় না। ডাল-ভাত খেয়ে দিন যাচ্ছে। লেখাপড়া ও ওষুধের খরচ চালাতে হিমশিম অবস্থা। আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি।' রেহেনা আরও জানান, ছোট মেয়ের কিডনির রোগ। মানুষের সহযোগিতায় ঢাকায় চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন ওষুধও কিনতে পারেন না অনেক সময়। ঋণের দায়ে বাড়ি নিলামে উঠলে মেয়েদের নিয়ে পথে নামতে হবে।
পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইউনুস আলী জানান, শহিদুল দানশীল ছিলেন। দুর্ঘটনায় পুরো পরিবার অথৈ সাগরে পড়েছে।
ময়মনসিংহের জাহিদুর রহমান বছর ছয়েক আগে ফাঁকা সড়কে দ্রুত মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন গতি পরীক্ষা করতে। ১১০ কিলোমিটার গতি তোলেন। গতির কারণে রাস্তার বাঁকে ঘুরতে না পেরে ক্ষেতে ছিটকে পড়েন। প্রাণে বাঁচলেও বহু দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। ডান হাত আজও ঠিকমতো কাজ করে না। আফসোস করে বলেন, গতি তোলা ঠিক হয়নি। একটি ভুল জীবনটাই বদলে দিয়েছে। পঙ্গু হয়ে গেছেন।
বাসে বাসে গতির লড়াইয়ে আহত হন হেলপার সিদ্দিকুর রহমান। তিনি যে বাসে ছিলেন, সেটির চালক মারা গেছেন। এর পর পরিবহনের কাজ ছেড়েছেন। সিদ্দিকুরের এখনও চোখে ভাসে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের সেই দুর্ঘটনা। ক্ষণিকের ভুল ও আইনভঙ্গ তাঁদের জীবন শেষ করে দিয়েছে।
সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা হলেও আহতদের নিয়ে কথা কমই হয়। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির পৃথক পরিসংখ্যানে বছরে ৫ থেকে ৮ হাজার মানুষ সড়কে আহত হন। নিসচার হিসাবে, আহতের ২০ শতাংশ চিকিৎসাধীন অবস্থায় বা অনেক দিন ভুগে মারা যান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনায় হতাহত বড় অংশই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। ২০২১ সালের হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতে ৩৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা জিডিপির ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
নিরাপদ সড়ক দিবসে র্যালি, প্রচারণা, আলোচনা সভাসহ বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সড়ক ব্যবহারকারী সব পক্ষ আইন মানলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমবে। যারা আইন মানছে না, তাদের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। সড়ক নিরাপত্তায় ১১১ দফা সুপারিশ ও প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা নির্দেশনার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারি হিসাবেই একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারালে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। তাই ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতেই হবে। একই দাবিতে গতকাল সংস্থাটি সংবাদ সম্মেলন করে রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে। এতে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, এমন ব্যবস্থা চাই, যাতে মানুষ নিরাপদে রাস্তায় চলতে পারবে। কর্মক্ষমতা ৬০ বছর পর্যন্ত ধরে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
এআরআইর সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, গাড়ির ত্রুটি বা সড়কের ত্রুটি- যে কারণেই দুর্ঘটনা হোক, মৃতের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়ক নির্মাণ, পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। দুর্ঘটনায় দোষীকে শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্তকে টেকসই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ, সেবক ও ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টার সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গত ১০ বছরে সড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হতো। ২০২১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭-তে। বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, 'দুর্ঘটনাগুলো আমাদের হাতে তৈরি। তাই এগুলোকে দুর্ঘটনা বলা যায় না।'
মন্তব্য করুন