
সৈয়দ আবুল মকসুদ: জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪৬ - মৃত্যু ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
গবেষক হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ স্বনামধন্য। তাঁর আলাদা মর্যাদা আছে। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে মনে হলো, বিভিন্ন সামাজিক তৎপরতায় তাঁর ভূমিকা লেখালেখির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জায়গাটাও সামাজিক আন্দোলনে।
লিখতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে প্রথমেই যে দিকগুলো চোখে ভাসছে তা হচ্ছে- তাঁর লেখালেখি, সভা-সেমিনারে সভাপতিত্ব করা, বক্তব্য দেওয়া এবং মানুষের অধিকার নিয়ে তাঁর রাস্তায় নেমে যাওয়ার দৃশ্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চিনতাম না, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতো এসব কাজে। বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি যেতেন। সেখানে আমরাও থাকতাম। দেখতাম, তিনি এসে ব্যানারের পেছনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন; অন্যদের বক্তব্য শুনছেন কিংবা সভায় তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসে বক্তব্য দিচ্ছেন।
বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে তাঁর বক্তব্য আমাদের আকৃষ্ট করত। কারণ যা বলতেন, মন থেকে বলতেন। কোনো ভান ছিল না। সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার এই নির্ভান ভূমিকার অভাব এখন খুব বোধ করি। তিনি নেই বলে নয়; তিনি যখন ছিলেন, তখনও বোধ করেছি। কারণ, তাঁর মতো আরও মানুষের দরকার ছিল আমাদের। এ ধরনের নিঃস্বার্থভাবে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মানুষ এখন বলতে গেলে চোখে পড়ে না।
আমরাও কোনো আয়োজন করলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতাম। তিনি আসতেন। কখনও বলতেন, গাড়ি পাঠালে ভালো হয়। আমরা তা-ই করতাম। সময়মতো উপস্থিত হয়ে আমাদের টেনশনমুক্ত করতেন। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, জিএমও বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফসল কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, মিছিল বা সেমিনার করলে সেখানেও তিনি উপস্থিত হতেন। সাধারণত এ ধরনের বিষয়ে 'বুদ্ধিজীবীরা' খুব একটা সাড়া দেন না। বীজের বিকৃতি ঘটানোর পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের বুদ্ধিমান সমাজ বিপজ্জনক মাত্রায় অসচেতন। তাঁরা তাঁদের বিশেষজ্ঞ বিষয়ের বাইরে কথা বলেন না। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল যে নিরন্তর পর্যালোচনার বিষয়, সে ব্যাপারে আমাদের বুদ্ধিমান সমাজের এখনও হুঁশ নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ অন্য রকম ছিলেন। তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর কাণ্ডজ্ঞান ছিল। তিনি বুঝতেন, জিএমও বা বিকৃত বীজ আমাদের কতটা ক্ষতি করতে পারে। তাঁকে যখন কাগজপত্র পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হতো, তিনি ঠিকই আসতেন এবং বক্তব্য দিতেন। তেমনি একটি জিএম ফসল বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান উবিনীগের উদ্যোগে যখন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যৌথভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করলাম, সেখানে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। সেখানে ভারতের বিশিষ্ট জিন বিজ্ঞানী ড. তুষার চক্রবর্তী প্রধান বক্তা ছিলেন। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে বিটি বেগুন বিরোধিতার বৈজ্ঞানিক যুক্তি শুনছিলেন। কেন বিটি বেগুন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, সেসব কথা আমরা নানা দিক থেকে আলোচনা করছিলাম। সেদিন তাঁর দেওয়া সভাপতির ভাষণ শুনে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম। এখানে এক ভিন্ন সৈয়দ আবুল মকসুদকে আমরা পাই, যাঁর জ্ঞান ও বিবেকের পরিমণ্ডল ইতিহাস গবেষণার বাইরে বৈজ্ঞানিক তর্ক-বিতর্কে প্রবেশ করতে পারে স্বচ্ছন্দে। এভাবেই তাঁর সঙ্গে আমাদের জানাশোনা এবং বলা যায় আত্মীয়তা।
সৈয়দ আবুল মকসুদকে দেখেছি সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে উৎকণ্ঠিত হতে, দেখেছি নারী নির্যাতনের ঘটনায় কষ্ট পেতে, পরিবেশের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান নিতে। এসব যেন তাঁর ব্যক্তিগত কষ্ট। তিনি যথাসাধ্য অবদান রাখার চেষ্টা করতেন। এমন মানুষ না থাকা আমাদের জন্য কত ক্ষতি, তা আমরা বুঝেছি গত দুই বছরে। সব সময়ই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ পরিকল্পনার সময় ভাবতাম- তিনি তো আছেন, ডাকলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি নেই। আমরা যাঁরা নানা বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইস্যু নিয়ে কাজ করি, আমাদের জন্য তাঁর অভাব প্রকটভাবেই জানান দেয়। তিনি হারিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু অবশ্যই বেঁচে আছেন তাঁর কর্ম, তাঁর লেখনী- সর্বোপরি আমাদের স্মৃতিতে।
ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার যতটুকু কথাবার্তা হয়েছে, তাতে বুঝেছি তিনি নারীদের সম্মান করতেন। আমরা তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট হলেও সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। পিঠ চাপড়ানিমূলক পুরুষতান্ত্রিক আচরণ কখনোই করেননি। তিনি নারীদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখলে তা তুলে ধরতেন এবং সেই কাজ তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকেই করতেন। তিনি বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, লেখক, রাজনৈতিক বিশ্নেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এমন একজনের নারী অধিকারের ব্যাপারে বিশেষ পর্যালোচনামূলক চিন্তাভাবনা নাও থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যে ঠিক নয়, সৈয়দ আবুল মকসুদ তা প্রমাণ করেছেন। যদি কেউ নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করেন, তাঁকে অবশ্যই নারী অধিকারের প্রশ্নে স্বচ্ছ হতে হবে। আমাদের জানতে হবে, যাঁরা সমাজের পরিবর্তন চান, যাঁরা বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, তাঁরা নারীকে কী চোখে দেখেন; নারী অধিকারের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার কেমন? পুরুষতন্ত্র নামে যে একটি আর্থসামাজিক ও ক্ষমতার সম্পর্ক সমাজে রয়েছে, সে ব্যাপারে অস্বচ্ছতা থাকলে তাঁর বুদ্ধিজীবিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। মকসুদ ভাই সেটা হতে দেননি।
লেখালেখিতেও মকসুদ ভাই এ বিষয়ে তাঁর চেষ্টা যথেষ্ট ফুটিয়ে তুলেছেন। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে 'বাঙ্গালী জাতি, বাঙ্গালী মুসলমান ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ' গ্রন্থটি। খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে একটি প্রবন্ধ 'মোসাম্মাৎ রেজিয়া খাতুন :এক বিস্মৃত মুসলমান নারীবাদী' শিরোনামে। নাম দেখে আগ্রহ হলো পড়ার। বিস্মৃতই বটে, বইটি না পড়লে আমরাও রেজিয়া খাতুন সম্পর্কে জানতাম না। মকসুদ ভাইয়ের মাধ্যমেই জানা হলো। এটা তাঁর একটা বড় অবদান। তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, ৭৫ বছরে সাহিত্য-সংস্কৃতি কিংবা কোনো নারীবাদী গবেষণায় রেজিয়া খাতুনের নাম এবং তাঁর কাজকর্মের কোনো উল্লেখ নেই। আমি মনে করি, এটা আমাদের জন্য লজ্জার।
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় আমরা ইতিহাস খুঁজে নারীর অবদান বের করার কাজ করি। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদের গ্রন্থটি বের হয়েছে ২০০৮ সালে। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা শত বছরে বাংলাদেশের শত নারীর পরিচয় তুলে ধরে ১৯৯৯ সালে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল, তখন আমাদের জানা থাকলে নিশ্চয়ই রেজিয়া খাতুনের পরিচয় অন্তর্ভুক্ত করা যেত এবং সেটা খুব ভালো হতো। দুঃখের বিষয়, সেটা হয়নি। চতুর্থ সংকলন (২০১০) করার সময়ও আমরা জানতে পারিনি। এই অক্ষমতা স্বীকার করছি।
সৈয়দ আবুল মকসুদকে অনেক ধন্যবাদ জানাই রেজিয়া খাতুনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। গবেষক হিসেবে এগুলো তাঁর কৃতিত্বের জায়গা।
ফরিদা আখতার: সভানেত্রী, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা; সম্মিলিত নারী সমাজের সদস্য; নয়াকৃষি আন্দোলনের সংগঠক
মন্তব্য করুন