মাদারীপুরের পুরান বাজার এলাকার রেজাউল আমিন মোল্লা ২০১৪ সাল থেকে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। কুমুতলাং শহরে মুদি দোকানের ব্যবসা করে ভালোই চলছিল তাঁর রোজগার। গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে তাঁর ভাই নিজামুর রহমান ও মাকে দফায় দফায় ফোন করে রেজাউলের মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। রেজাউলকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও স্বজনের কাছে পাঠায় অপহরণকারীরা। পরে আফ্রিকার পুলিশ নিশ্চিত হয়, পাচারকারীরা রেজাউলকে হত্যা করেছে।

আইনি জটিলতার কারণে এখনও তাঁর লাশ দেশে আনা যায়নি। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেছেন স্বজনরা। এরই মধ্যে রেজাউলের স্বজনের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। নমুনা মেলানোর প্রক্রিয়া শেষ হলে লাশ ফেরত আসবে দেশে। সম্প্রতি রেজাউল হত্যা ও চাঁদপুরের কচুয়ার করইশ এলাকার রিয়াদ হোসেন পাটোয়ারী নামে আরেক তরুণকে জিম্মি করার ঘটনার তদন্ত করতে দক্ষিণ আফ্রিকায় যায় বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের ডিসি আশরাফ হোসেন ছাড়াও ওই প্রতিনিধি দলে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। তাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ ও সাক্ষীদের জবানবন্দি নেন। দেশটিতে সফরকারী প্রতিনিধি দলকে ২০৭ বাংলাদেশির পাসপোর্টের তথ্যসহ একটি তালিকা দিয়েছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। সংস্থাটির ভাষ্য, এই চক্রটি দীর্ঘদিন আফ্রিকায় ছোট-বড় নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তালিকাভুক্তদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ইন্টারপোলের কাছ থেকে পাওয়া তালিকাভুক্তদের ব্যাপারে বিশদ খোঁজখবর নিচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। তাদের খুঁজে বের করা ছাড়াও পাসপোর্টের তথ্য ধরে প্রত্যেকের স্বজনের ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির ওয়ারী বিভাগের ডিসি আশরাফ হোসেন সমকালকে বলেন, ইন্টারপোল প্রাথমিকভাবে ২০৭ জনের তালিকা দিয়েছে। আফ্রিকায় তারা বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত। কেউ কেউ মামলার আসামি। অনেকে আবার বাংলাদেশে চলে এসেছে। তালিকাভুক্ত সবার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করছি। প্রত্যেককে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখব। পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তাদের সুপথে আনার চেষ্টা করা হবে।

জানা গেছে, আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। জোহানেসবার্গ, কেপটাউন, ডারবান, ইস্টার্ন কেপ ছাড়াও অন্য এলাকায় নানা ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। পাকিস্তানি, ভারতীয়, আফ্রিকান ছাড়াও বাংলাদেশিরা অপরাধ চক্র গড়ে তুলেছে। কোথাও রয়েছে গ্যাংস্টার গ্রুপ।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি বাংলাদেশি বাস করছেন। বাংলাদেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে যাঁরা সেখানে যান প্রথমে ছোটখাটো চাকরি করার পর অনেকে ব্যবসা শুরু করেন। অধিকাংশ প্রবাসী মুদি দোকান চালান। অনেকে আবার ডিপার্টমেন্ট স্টোর, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস এবং টেকনোলজি অ্যাকসেসরিজসহ নানা ধরনের পণ্যের দোকান দিচ্ছেন। বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশিদের কাছে আফ্রিকা জনপ্রিয় স্থান। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসার তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ১২তম। ওই অর্থবছর দেশটি থেকে ৩১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যদিও আফ্রিকায় নানা ধরনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাজ করতে হয়। ২০১৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৫৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি সেখানে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই ঘটেছে ব্যবসায়িক বিরোধ, মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে হত্যা, ব্যক্তিগত ও নারীঘটিত দ্বন্দ্বের কারণে। আবার দোকানে চুরি ও ডাকাতিতে বাধা দিতে গিয়েও খুনাখুনি হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশি যারা সংঘবদ্ধ অপরাধে যুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। তাদের এই অপকর্ম প্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ইন্টারপোলের তালিকায় কার কোথায় অবস্থান সেটা খুঁজে বের করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। যেহেতু পাসপোর্টের তথ্য পাওয়া গেছে, কাউকে পাওয়া না গেলে তাদের স্বজনদের খুঁজে বের করা হবে। দেশে-বিদেশে কোথাও বসে প্রবাসীদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে দেওয়া হবে না। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায়ই বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন দোকানপাটে হামলা ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটছে।