
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে ভেঙে যাওয়া নৌকার পাশে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার লুধুয়া মাছঘাটের জেলে শাহাবউদ্দিন মাঝি। শনিবারের ছবি-সমকাল
সাহাবউদ্দিন মাঝির বয়স ৪৫। মেঘনায় মাছ শিকার তাঁর পৈতৃক পেশা। দীর্ঘ আড়াই যুগ ধরে এ পেশায় কাটালেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বরং যে নদীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পথচলা, সেই মেঘনাই যেন অভিশাপ হয়ে উঠেছে। দুই বছর আগে ঘরবাড়ি গিলে খাওয়া মেঘনা এখন কেড়ে নিয়েছে তাঁর আয়-রোজগারের শেষ সম্বল মাছ ধরার নৌকাটি। গত শুক্রবার রাতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে মাছ শিকারে নদীতে নামতে পারছেন না লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার লুধুয়া মাছঘাট এলাকার এই জেলে।
সাহাবউদ্দিন মাঝি জানান, মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি তিনি মাছঘাট এলাকায় নদীতীরে নোঙর করে রেখেছিলেন। সরকারি কোনো সহায়তা না পেয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছিল। অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন নিষেধাজ্ঞা কবে শেষ হবে। কিন্তু এরই মধ্যে ২৪ অক্টোবর রাতে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। তীব্র ঢেউয়ে নৌকাটি মালপত্রসহ ডুবে যায়। পরদিন নৌকাটি উদ্ধার করলেও পেয়েছেন ভাঙাচোরা, জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায়। মাছ শিকারে যেতে না পারলে পথে বসতে হবে। ওই নৌকার পাঁচ জেলে এখন চরম হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। নিষেধাজ্ঞা শেষে অন্য জেলেরা আনন্দ-উল্লাস করে মাছ শিকারে গেছেন। হতাশ সাহাবউদ্দিন মাঝি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সাহাবউদ্দিন মাঝি জানান, তাঁর জেলে পরিচয়পত্র থাকলেও নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। দুই বছর আগে ভিজিএফ সহায়তার চাল পেলেও এর পর থেকে তা আর মিলছে না।
শুধু সাহাবউদ্দিন নন, এ রকম নানা দুঃখ-দুর্দশায় রয়েছেন মেঘনায় মাছ শিকারি বহু জেলে। গতকাল শনিবার মেঘনা নদীতীরবর্তী কমলনগর উপজেলার লুধুয়া ফলকন ও মাতব্বরহাট মাছঘাটসহ বিভিন্ন মাছঘাট ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে।
জেলেরা জানান, আড়াতদারদের শোষণ, জলদস্যুদের হানা, নিষিদ্ধ সময়ে সরকারের দেওয়া সহায়তা না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অসংখ্য সমস্যায় জেলেরা জর্জরিত। কামাল মাঝি, রফিকুল ইসলাম, হক সাহেব, কবির হোসেন, রিয়াজ হোসেন ও রহমান মাঝির নৌকাসহ অন্তত ১০০টি নৌকা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে নদী-খালে ডুবে ও ভেঙে যায়। প্রতিটি নৌকার সঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় জেলে পরিবারের রুটি-রুজি জড়িত।
একই দশায় কমলনগর উপজেলার মতিরহাট, নাছিরগঞ্জ, মাতব্বরহাট, লুধুয়া ও পাটারীরহাট এবং রামগতি উপজেলার বালুরচর, আসলপাড়া, চরআলগী, রামগতিরহাট, টাঙ্কি বাজার ও চেয়ারম্যান বাজার মাছঘাট এলাকার জেলেদের।
স্থানীয় জেলে সমিতির নেতা আব্দুল ওহাব কালু মাঝি জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সংকটে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকার তাঁদের দিকে নজর দিচ্ছে না। কমলনগর উপজেলার লুধুয়া মাছঘাটের ব্যবসায়ী মোসলেহ উদ্দিন জানান, জেলেরা এখন নদীতে মাছ শিকারে যেতে না পেরে খুবই কষ্টে রয়েছেন।
কমলনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল কুদ্দুস ও রামগতির সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন জানান, কমলনগরে সাড়ে ১১ হাজার এবং রামগতিতে ২০ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। যাঁরা সহায়তা পাননি, বরাদ্দ পেলে দেওয়া হবে।
'খাইয়া না খাইয়া কাটে দিন' :'চার হাত-পা দিয়েই সাংসার চালাইতে হয়। সাগরে মাছ ধরতে পারলে মোগ সংসার চলে, আর না ধরতে পারলে চলে না। খাইয়া না খাইয়া কটে দিন।' কথাগুলো বলছিলেন লালুয়া ইউনিয়নের চর চান্দুপাড়ার জেলে রুবেল হাওলাদার। স্ত্রী, তিন মেয়ে, এক ছেলেসহ ছয়জনের সংসার। ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন রুবেল। নিজের থাকার জায়গা নেই।
উপজেলার জেলে অধ্যুষিত লালুয়া ইউনিয়নের শত শত জেলে পরিবার নানা সংকটের মধ্যে দিন পার করছে। করোনার প্রাদুর্ভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সিত্রাংয়ের আঘাত, সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় জেলেদের জীবনে চলছে মহাসংকট। অনেকে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। চরম হতাশায় ভুগছে এসব জেলে পরিবার।
মো. কামাল মাঝি বলেন, মহাজনের কাছে থেকে দাদন নিয়ে ৪ লাখ টাকায় একটি ট্রলার তৈরি করেন। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে ট্রলাটির ভেঙে গেছে। সরকারি সহায়তার চাল এখনও পাননি। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা সমকালকে বলেন, এ উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৩০৫ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। বন্যায় সব জেলেকে চাল দেওয়া যায়নি। বঞ্চিতদের চাল দেওয়া হবে দু-এক দিনের মধ্যে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) থেকে বেলাল হোসেন জুয়েল ও কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে এসএম মোশারফ হোসেন মিন্টু]
মন্তব্য করুন