গ্রামের পথে রাতের অন্ধকারে আলো ছড়ানোর জন্যই নেওয়া হয়েছিল 'আলোকিত পল্লি সড়কবাতি' প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৯টি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে সৌরবাতি। সেই বাতির আলো এখন আর রাস্তায় পড়ে না। সেখানে আগের মতোই ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের ফলে ব্যর্থ হতে বসেছে প্রকল্পটি। ফলে সরকারের প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত আলো ছড়ানোর প্রকল্পটি এখন অন্ধকারে ডুবতে বসেছে।

আলো থাকলে গ্রামীণ সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে। অর্থনৈতিক উন্নতি হবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর। রাতের বেলায় মানুষ যাতে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে, এটিই ছিল সৌরবাতি প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
এ কারণে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের সমবায় বিভাগের উদ্যোগে ৪৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে দেশের আট বিভাগের ১৩টি জেলার ১৯টি উপজেলার সড়কে সৌরবাতি বসানোর কাজ শুরু হয়। প্রায় ছয় মাস আগে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিন বছরে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি প্রকল্প ব্যয় আরও ১২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। কিন্তু যেসব এলাকায় ইতোমধ্যে সৌরবাতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোর খুঁটির কোনোটা হেলে পড়েছে, কোনোটাতে আলো জ্বলে না। কোনো খুঁটির গোড়ায় সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া হয়নি। একেবারে নিম্নমানের কাজসহ নানা গাফিলতিতে কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

এ-সংক্রান্ত একটি অভিযোগ এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ার পর কয়েকটি এলাকার জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন দেখে হতাশ হয়েছেন। তাঁদের মতামতেও প্রকল্পের নাজুক চিত্র উঠে এসেছে। সমকালের পক্ষ থেকেও কয়েকটি এলাকায় খবর নিয়ে জানা যায়, স্থাপিত বাতিগুলোর ৬০ শতাংশই জ্বলে না। বাকিগুলোও নিভুনিভু।

পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি এটিএম মাজহারুল আলম মিলন জানান, পীরগঞ্জ বন্দর থেকে খালাসপীর পর্যন্ত মাঝে মাঝে সৌরবাতি দেখা গেলেও ঠিকমতো জ্বলে না। যেগুলো জ্বলে সেগুলোর উজ্জ্বলতা কম। কয়েকটি বাতি জ্বলে-নেভে। পীরগঞ্জ ইউনিয়নের (৯ নম্বর ইউনিয়ন) বাতিগুলোর একই অবস্থা। অথচ বছরখানেকও হয়নি এগুলো লাগানো হয়েছে।

মিঠাপুকুর (রংপুর) প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান জানান, মিঠাপুকুরের সখিবাড়ি থেকে বাজিয়া-মাসুমপুর-আফতাবগঞ্জ সড়কের বাতিগুলো দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। এক-দেড় বছর আগে এগুলো লাগানো হয়েছে।
মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বলেন, মাধবপুর ইটভাটার কাছে দুটি মাত্র বাতি জ্বলে। চাউলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাফিজার রহমান বলেন, পাল্লা থেকে বজরুক শ্রীকুণ্ডিসহ কয়েকটি রাস্তায় লাগানো শখানেক বাতির অধিকাংশই জ্বলে না।

শ্রীপুর উপজেলার নাকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন রশিদ মুহিব বলেন, আমার ইউনিয়নের শখানেক বাতির অর্ধেকেরও বেশি জ্বলে না। খুঁটিতে থাকা ঠিকাদারের ফোন নম্বরে ফোন দিলেও ধরে না। ধরলেও বলে ঢাকায় আছি।
আগৈলঝাড়া (বরিশাল) প্রতিনিধি মো. আজাদ জানান, এক বছর আগে গৌরনদী থেকে নাটই আর আগৈলঝাড়ার দাসেরহাট থেকে সুজনকাঠি পর্যন্ত রাস্তায় বসানো সৌরবাতিগুলোর কোনোটা জ্বলে কোনোটা জ্বলে না।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ থানার আরশীনগর ইউনিয়নের ৬৭০নং পিলারে দেখা গেছে সোলার প্যানেল থাকলেও কোনো বাতি নেই। ২২৪ নম্বর পিলারে বাতি-প্যানেল থাকলেও জ্বলে না। ৮০ নম্বর খুঁটিরও একই দশা। এ ছাড়া তিনটি খুঁটির কোনোটির গোড়াতেই কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়নি।


এ প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পড়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ইস্পাতের তৈরি খুঁটিগুলোর ব্যাসার্ধ যা দেওয়ার কথা তা দেওয়া হয়নি। এগুলো আদতে কোনো খাম্বা নয়, ইস্পাতের তৈরি চিকন কাঠি বিশেষ। খুঁটিগুলোও ৩ ইঞ্চি ডায়ার পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে আড়াই ইঞ্চি। পুরুত্ব সোয়া ৩ ইঞ্চি থাকার কথা থাকলেও তা নেই। প্রতিটি বাতির তিন বছর পরিচালনের কথা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের, সেটাও তারা করছে না।

তবে সৌরবাতি প্রকল্প বাস্তবায়নের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিকে করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী দুলাল কর্মকার দাবি করেন, 'একেকটি এলাকায় ৮০০টি করে বাতি দিয়েছি। এর মধ্যে দুই-চারটি হয়তো নাও জ্বলতে পারে। তাই বলে ৬০ শতাংশ বাতি জ্বলবে না তা হয় না। ডায়া-থিকনেসও কম থাকার কোনো কারণ নেই। ফোন দিলে পাওয়া যায় না- এটাও ঠিক নয়। ওখানে আমাদের লোক দেওয়া আছে। প্রতি তিন মাস অন্তর আমাদের রিপোর্ট দিতে হয়। বিষয়টি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান পিডিবিএফ প্রতিনিয়ত পরিদর্শন করে। তারপরও আমাদের ভুলত্রুটি হতে পারে।'

প্রকল্প পরিচালক গৌতম ভৌমিক সমকালকে বলেন, ভেদরগঞ্জের ৭৫০টি বাতির মধ্যে কয়েকটি বাতির সমস্যা আছে। বন্যা ও বৃষ্টির কারণে কয়েকটি এলাকার খুঁটির গোড়ার মাটি সরে যায়। কয়েকটি জায়গায় ঝড়ে গাছ পড়ে লাইট ভেঙে ছিল।
তিনি বলেন, একটি-দুটি মেরামতের জন্য ঢাকা থেকে যাওয়া যায় না। যখন ৫-১০টি বাতি নষ্ট হয়, তখন ঠিকাদারকে বলা হয়। তারা ঢাকা থেকে লোক পাঠিয়ে ঠিক করে দেয়। ওখান থেকে প্রত্যয়নপত্রও নিয়ে আসে। আমাদের জাতীয় গ্রিডেও তো সমস্যা হয়। সারাদিন সূর্যের আলো না পেলে তো বাতি জ্বলবে না। অনেক স্থানে গাছপালার ছায়া পড়ে। তখন দেখা যায় রাত ১১-১২টার পর বাতি নিভে যায়। এ জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানদের এ রকম গাছগুলোর ডাল কেটে দিতে বলা হয়েছে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি আছে তারা তিন বছর দেখভাল করবে। এর আগে যে কোনো সমস্যা হলে ঠিকাদার দেখবে।

জানা গেছে, ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ কাজ পেলেও তারা নিজে না করে কাজটি করছে ডিকে করপোরেশন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথম দফায় অনেক অনিয়ম করে ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দফার দরপত্রে এমন কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে যাতে ওই প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ দরপত্রে অংশই নিতে না পারে। আর এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন একজন প্রতিমন্ত্রীর ছেলে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এ প্রকল্পের কর্মকর্তারা। তাঁদের উৎকোচ বাণিজ্যের কারণেই এমন ভালো প্রকল্পের বেহাল অবস্থা।

প্রকল্পের সার্বিক তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মওদুদুর রশিদ সফদার সমকালকে বলেন, সৌরবাতি নিয়ে এ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে এই সৌরবাতি একটি পূর্ণ সেটআপ, এ পদ্ধতির কোনো একটি জায়গায় সমস্যা হলে বাতি নাও জ্বলতে পারে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিজে কাজ না করে অন্যকে দিয়ে কাজ করানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড় ধরনের কোনো প্রকল্প হলে ঠিকাদার চাইলে অন্য ঠিকাদারের সহযোগিতা নিতে পারেন।



বিষয় : পল্লি সড়কবাতি

মন্তব্য করুন