কাওড়াকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চ। ঈদুল ফিতরের পর পদ্মা নদীতে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়, নিখোঁজ থাকেন ৬৪ জন। নিহতের মধ্যে ২১ জনের পরিচয় না পেয়ে দাফন করা হয় শিবচর পৌর কবরস্থানে। এ দুর্ঘটনা নিয়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানা ও ঢাকার নৌ আদালতে দুটি মামলা হয়েছে। মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিন পান। এসব মামলার বিচার শুরু হয়নি এখনও। আসামি পক্ষের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

দেশে প্রতি বছরই ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খবর তেমন পাওয়া যায় না। শুধু স্থগিতাদেশ নয়, তদন্তে বিলম্ব, মামলায় সাক্ষী হাজির না হওয়া, রাষ্ট্র পক্ষের উদাসীনতাসহ নানা কারণে অনেক মামলার বিচার ঝুলে রয়েছে নৌ আদালতে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে স্থাপিত দেশের একমাত্র নৌ আদালতে (মেরিন কোর্ট) বর্তমানে সাড়ে ৩ হাজার মামলা বিচারাধীন। ঢাকার সিএমএম আদালতের অধীন এই আদালতের বিচারক হন একজন যুগ্ম ও দায়রা জজ। অনেক পুরোনো মামলা বিচারাধীন থাকলেও গত মাস থেকে এ আদালতে কোনো বিচারক নেই। তাই বিচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এ আদালতে বর্তমানে ১৭০টি দুর্ঘটনাজনিত মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দুর্ঘটনাসহ তিন ধরনের মামলা হয়ে থাকে এখানে। আদালতে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দায়ের করা ১৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সাক্ষী না পাওয়ায় এসব মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ১৬টি মামলার মধ্যে ১১টি দুর্ঘটনাজনিত, বাকি ৫টি অন্যান্য কারণে। মামলাগুলোর মধ্যে ৬টির সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান, দুটির যুক্তিতর্ক অব্যাহত রয়েছে, একটির কার্যক্রম হাইকোর্টে নির্দেশে স্থগিত, বাকি মামলাগুলোর বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হবে জানিয়ে বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন সমকালকে বলেন, এসব মামলায় সাক্ষীদের অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া আইনগত নানা কারণে মামলা নিষ্পত্তি করতে দেরি হচ্ছে। সাক্ষী আদালতে হাজির না হলে বিচারকের কিছুই করার থাকে না। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে নৌ আদালতে বিচারক নেই। পদোন্নতি হওয়ায় বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। নতুন বিচারক যোগ দেওয়ার পর পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে ২ হাজার ৫৭২টি নৌ দুর্ঘটনায় সাড়ে ২০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ৬৩৪টি নৌ দুর্ঘটনায় ৮৫৬টি মামলা হয়। নৌযানের ফিটনেস না থাকা ও চালকের অদক্ষতার কারণে সাধারণত দুর্ঘটনা ঘটে। সংশ্নিষ্টরা জানান, নৌ দুর্ঘটনার মামলায় চালক, সুকানি, খালাসীদের সাজা হয়েছে মাত্র দুই-একটি ক্ষেত্রে। নৌ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তারা নৌযানের ফিটনেস সনদপত্র এবং ছাড়পত্র দেন। তবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দায় এড়িয়ে যান। তাদের বিরুদ্ধে দুর্ঘটনার কারণে মামলা হয় না। সরকারি-বেসরকারি হিসেবে ২০২১ সালে নৌ দুর্ঘটনা হয়েছে ৫ শতাধিক। ২০২০ সালে দেশে ১,২০৩টি নৌ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৫৩ জন। ২০১৯ সালে ৮২০টি দুর্ঘটনায় ৬৮৫ জন এবং ২০১৮ সালে ৫০৮টি দুর্ঘটনার ৪২৬ জন নিহত হন।

নৌ আদালত স্থানান্তরের দাবি :নৌ অধ্যাদেশের আওতায় মামলা হলে মতিঝিল বিআইডব্লিউটিএ ভবনের আটতলায় নৌ আদালতে মামলার বিচার চলে। ফৌজদারি দ বিধিতে মামলা হলে বিচার হয় ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে। অভিযোগ রয়েছে, নৌ আদালতে বাইরের কোনো আইনজীবীকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সেখানে নির্দিষ্ট কয়েকজন আইনজীবী মামলা করে থাকেন। তাঁদের সাহায্য নিতে হয় বাইরের আইনজীবীদের। সেখানে বিচারের পরিবেশ নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। এটিকে মূল ধারার আদালত হিসেবে দেখতে চান অনেক আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী। পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় এটি স্থানান্তরেরও দাবি তুলেছেন তাঁরা।

আপিল আদালতের প্রস্তাব :নৌ আদালতের পাশাপাশি একটি আপিল আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে নৌ অধিদপ্তর থেকে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, আপিল আদালত হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সহজ হবে। এতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।