নোয়াখালীর সুবর্ণচরের পূর্বচরবাটা ইউনিয়নের চর নঙ্গলিয়া গ্রামের মাহমুদুল হাসান সৌদি আরবে কাটিয়েছেন ১০ বছর। গত বছর জুনে দেশে ফিরে গড়ে তোলেন গরুর খামার। উন্নত জাতের ১২টি গরু দিয়ে খামার শুরু হলেও তিন মাস পরই পান আঘাত। অসুস্থ হয়ে চারটি গরু মারা যায়। গ্রাম্য পশু চিকিৎসক দেখে ওষুধ প্রয়োগ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। লোকসান কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাওয়া মাহমুদুল এখনও জানতে পারেননি, তাঁর গরুগুলোর মৃত্যুর কারণ। তিনি বলেন, 'পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ প্রয়োগ করেন চিকিৎসক। তৃণমূলের বেশিরভাগ খামারির আমার মতোই অবস্থা। সঠিক চিকিৎসা, ওষুধ কিংবা পরমার্শ- কিছুই পাচ্ছেন।'

এ সংকটের কারণ ব্যাখ্যা করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তার (ইউএলও-ভিএস) পদ ৮৭৫টি হলেও কর্মরত মাত্র ৩১৪ জন। সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রাণিসম্পদ কার্যালয়গুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, টিকা ও ওষুধের সংকট রয়েছে। আবার টিকা দেওয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই সচেতনতা। এতে প্রতিবছর প্রাণিসম্পদের বড় অংশ টিকার বাইরে থেকে যায় ও রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। স্থানীয়রা বাড়তি অর্থ গুনলেও কথিত পশু চিকিৎসকদের ভুল পরামর্শে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা।

এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রান্তিক খামারিদের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সরকার নিয়েছে নতুন উদ্যোগ। চালু হচ্ছে লাইভস্টক ফার্মারস ফিল্ড স্কুল (এলএফএফএস)। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় প্রান্তিক খামারিদের নিয়ে ভ্যালু চেইনভিত্তিক সাড়ে ৫ হাজার প্রডিউসার গ্রুপ (পিজি) গঠন হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য ২০-৪০ খামারি। এসব গ্রুপের মাধ্যমে খামারিদের কাছে সহায়তা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি প্রভৃতি পৌঁছে দেওয়া হবে। বাড়ানো হবে তাঁদের সক্ষমতা।

ইতোমধ্যে প্রতিটি গ্রুপের আলাদা প্রোফাইল ও ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের কাছে পৌঁছে গেছে সাইনবোর্ড, আইডি কার্ড, রেজিস্ট্রেশন বুক, কার্যবিবরণী রেজিস্ট্রার, গঠনতন্ত্র, হিসাব ও সঞ্চয় বই। সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে প্রতিটি গ্রুপের নিবন্ধন হবে। প্রডিউসার গ্রুপভিত্তিক একটি করে লাইভস্টক ফার্মারস ফিল্ড স্কুল পরিচালিত হবে। এ লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ ও এলডিডিপির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আধুনিক খামার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহযোগিতার পাশাপাশি গ্রুপের মাধ্যমে ওষুধ, টিকা, দৈনন্দিন ব্যবহার সামগ্রী, উন্নত জাতের ঘাসের কাটিংসহ নানা যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে।

এলডিডিপি প্রকল্পের প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, প্রডিউসার গ্রুপই এ প্রকল্পের প্রাণ। খামারিদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ম্যাচিং গ্রান্ট দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ (খাদ্য, পুষ্টি, রোগ ইত্যাদি) শক্তিশালী করার পাশাপাশি ফরোয়ার্ড লিংকেজ (বাজার সংযোগ সৃষ্টি, ভ্যালু এডিশন ইত্যাদি) বাড়াতেও সহযোগিতা করা হবে। উৎপাদিত মাংস বিক্রিতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে স্লটার হাউস ও স্লটার স্লাব নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, স্কুলের শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষক গ্রুপগুলো খামারে উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তি জ্ঞান চর্চায় অভ্যস্ত হবেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, জাতিসংঘের এফএওর কারিগরি সহায়তায় গ্রুপভিত্তিক স্কুল পরিচালিত হবে। কোর্স-কারিকুলাম প্রায় চূড়ান্ত। আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করছি।