- বাংলাদেশ
- দেশভাগের জীবন্ত উপাখ্যান
দেশভাগের জীবন্ত উপাখ্যান
-samakal-638ed7aa4b50f.jpg)
পাঠচক্র শেষে আলোচক অধ্যাপক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজের সঙ্গে সুহৃদরা
সমকালের পাঠক সংগঠন সুহৃদ সমাবেশের পাঠচক্রে অংশগ্রহণ ছিল একটি সুখময় অভিজ্ঞতা। হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস 'আগুনপাখি' গ্রন্থের ওপর বিভিন্ন পাঠকের আলোচনায় তুলনামূলক সমালোচনার উপভোগ্য আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। কবি মাহবুব আজীজের সূচনা বক্তব্যের পর 'আগুনপাখি' নিয়ে আলোচনা করেন দু'জন সুহৃদ। তাঁরা উপন্যাসটি পড়ে নিজের মতো করে উপলব্ধি করেছেন। শেষে পঠনদীপ্ত আলোচনা করেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান। তাঁর আগে আমাকে কিছু বলতে হয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল সামগ্রিক মূল্যায়নের পরিবর্তে কয়েকটি 'ক্রিটিক্যাল পারসপেক্টিভ'-এর প্রতি তরুণ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ।
বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হক ছোটগল্প লেখক হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। ২০০৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস 'আগুনপাখি' প্রকাশিত হলে বাংলাভাষী পাঠকমহল ন্যায্যতই কৌতূহলী হয়ে ওঠে। উপন্যাস সাহিত্যের এমন একটি রূপবন্ধ, যার সংজ্ঞায়িত স্বভাব নেই, নির্দিষ্ট চৌহদ্দি নেই, নেই আদর্শস্থানীয় শিল্পরূপ। তাই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একটি উপন্যাসকে ব্যবচ্ছেদ করা সম্ভব। আমি মূলত তিনটি বিষয়ে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম।
'আগুনপাখি' একটি আত্মকথনমূলক উপন্যাস। 'আগুনপাখি' প্রথমোক্ত গোত্রীয়, যাতে কথকের নিজ জবানিতে নিজের জীবনের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। 'আগুনপাখি'র প্রোটেগনিস্ট একজন নারী, যাঁর নাম আনুপূর্ব উহ্য রাখা হয়েছে।
নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি আটাশটি খণ্ডে সজ্জিত, যার প্রতিটির শিরোনাম দিয়েছেন লেখক। প্রথম খণ্ডের শিরোনাম 'ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো'। বলার অপেক্ষা রাখে না শিরোনামটি স্বতঃস্পষ্ট নয়। অন্যত্র 'পৃথিবীর পেরজা আর কত বাড়বে' শিরোনামীয় খণ্ডের কিছু অংশ এ রকম :'ত্যাকন আমি খুব পেরেশান, চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। ভোগাবে মনে হচে পেটের এই সন্তানটি। এই সোমায় একদিন দোপরবেলায় হিঁদুপাড়ায় লাগল আগুন।...কিন্তুক এত সৌন্দর্য হলে কী হবে, চাল যি সব খড়ের! কত বাহার করে ছাঁচ কাটা! শালকাঠ, তালগাছের কাঁড়ি, বাঁশ- এইসব দিয়ে চালের তলার কাঠামো এমন দবজ করে তৈরি যি বোশেখ জষ্টি আশিন কাত্তিকের ঝড়েও কিছু হবে না। কিন্তুক আগুনের কাছে সব জব্দ।'
কেবল এই অংশটি নয়, ২৪৬ পৃষ্ঠার পুরো উপন্যাসটি রাঢ়বঙ্গের এহেন আঞ্চলিক ভাষায় লিখেছেন হাসান আজিজুল হক। ফলে তা পরিণত হয়েছে বাংলাভাষার অসাধারণ একটি সাহিত্যকর্মে। আমরা প্রশ্ন করতে পারি :ভাষার কাজ কি? ভাষার কাজ অর্থ তৈরি করা- এমন অর্থ যা পাঠকের মননে বোধগম্য। 'আগুনপাখি' লেখার সময় হাসান আজিজুল হক ভাষার এই মৌল অভিলক্ষ্যটি উপেক্ষা করেছেন। এতে পাঠক অতিরিক্ত কী পেয়েছে এবং কী হারিয়েছে তার হিসাব কষার প্রশ্ন থাকতে পারে। এতে গদ্যের প্রসাদ গুণ নষ্ট হয়েছে কি? পুরো উপন্যাসটিকে প্রমিত বাংলায় লিখলে শিল্প হিসেবে উপন্যাসটির কতখানি ক্ষতি বৃদ্ধি হতো?
'আগুনপাখি' এক নারীর জীবনসংগ্রামের বিশ্বস্ত কাহিনি। এর উপজীব্য করেছেন ব্রিটিশ শাসনাবসান কালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। এক্ষেত্রে স্বীয়
উদ্দেশ্যমূলকতা অবগুণ্ঠিত রাখেননি তিনি। ওপরতলার রাজনীতির ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মীয় ভিত্তিতে। ধর্মের কারণে অনেক মানুষকে বেছে নিতে হলো অভিপ্রয়াণ- পিতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি দিতে হলো নবচিহ্নিত রাষ্ট্রীয় সীমানা। কিন্তু সকল সামাজিক ও পারিবারিক চাপ উপেক্ষা করেছে আগুনপাখির নারী প্রোটেগনিস্ট। সে থেকে গেছে নিজের ভিটায়। কিন্তু কেন? এমতরূপ সিদ্ধান্ত কি তবে কোনো নারীবাদী প্রতিবাদ? ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে আগুনপাখির পুনরুত্থানের ইঙ্গিত?
হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে দেশভাগের যন্ত্রণা পৌনঃপুনিকভাবে উপস্থিত। এটাও ব্যতিক্রম নয়। কথকনারীর বয়ানে দেশভাগের ন্যায্যতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন লেখক। এ উপন্যাসের অবয়বে কথকনারীর আত্মকাহন বাংলার একটি বিশেষ সময়ের দলিল হয়ে উঠেছে। একজন সাহিত্যামোদী বিশ্নেষণ করে দেখাতে পারেন সময়ের এই দলিল কীভাবে সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়েছে।
মন্তব্য করুন