'ওরা আমার স্বামীকে কেন মেরে ফেলল? তাঁর কী দোষ ছিল?' বারবার এ প্রশ্নে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন স্বামী হারানো ফরিদা হোসেন। স্বজনরা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিছুটা সময় বাকরুদ্ধ থেকে আবারও কান্না জুড়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ওয়ারী এলাকার গোপী মোহন বসাক লেনের ৩০ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে এ চিত্র দেখা গেছে। পরিবারের সদস্যদের দাবি, বুধবার মধ্যরাতে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক ভবনটিতে খুঁজতে আসেন মৃত মিল্লাত হোসেনের ছেলে ফয়সাল মেহবুব মিজুকে। মিজু ওয়ারী থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। তাঁকে বাসায় না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মিজুর চাচা শাহাদাত হোসেন স্বপনকে দেখতে পান। তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দেন মিল্লাত হোসেন। এ সময় তিনি তাঁদের আঘাতে মারা যান। তবে পুলিশ বলছে, মিল্লাত হোসেন উত্তেজিত হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

সরেজমিন মিল্লাত হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাসার সামনে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন স্বজনরা। বাসার দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে ডুকরে কাঁদছেন মিল্লাতের স্ত্রী। পাশে আরেকটি কক্ষে নির্বাক বসে মিল্লাতের ৯০ বছর বয়সী মা ফজিলাতুন্নেসা। স্বজনরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বারান্দায় কথা হয় মিল্লাতের ছোট ভাই হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, মধ্যরাতে বাসায় এসে দেখি মিজুর খোঁজে জোরে জোরে দ্বিতীয় তলার গেটে আওয়াজ করছেন কয়েকজন। আওয়াজ পেয়ে মিল্লাত ভাই গেট খুলে দেন। তাঁরা মিজুর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বাসায় নেই জানতে পেরে তাঁরা নিচে নেমে যান। তিনি বলেন, একটু পর বাসার ছাদে তাঁদের আরেক ভাই শাহাদাত হোসেন স্বপনকে দেখতে পান হামলাকারীরা। কয়েকজন 'পাইছি তরে, খাইছি!' বলে চেঁচিয়ে আবার বাসায় উঠে যান।

বাসার দ্বিতীয় তলার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন মিল্লাতের বোন বুলবুলি ইয়াসমিন। তিনি জানান, 'পাইছি' 'পাইছি' বলে ছাদ থেকে তিন-চারজন তাঁর ভাই স্বপনকে ধরে বাসার দ্বিতীয় তলার বারান্দায় নামিয়ে আনেন। তিনি তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, 'আপনারা কে? পুলিশ হলে ওয়ারেন্ট কোথায়?' এ সময় তাঁরা 'ছাড়, নইলে গুলি করুম' বলে হুমকি দেন। মিল্লাত ভাই পেছন থেকে তাঁদের ছেড়ে দিতে বলেন। একটু পর তিনি দেখেন মিল্লাত ভাই লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর মাথার পেছন দিক থেকে রক্ত ঝরছে। বুলবুলি বলেন, শক্ত কিছু দিয়ে তার ভাইকে আঘাত করা হয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের সদস্যদের দাবি, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তাঁদের দাবি, মিল্লাত হোসেনের ভাই স্বপন সম্প্রতি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সঙ্গে একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেন। তাঁরা জানান, ১৯৯০ সালের দিকে এলাকায় বিএনপির পোস্টারের ওপর আওয়ামী লীগের পোস্টার লাগানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বপনের দুই বন্ধুকে হত্যা করা হয়। ওই হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন স্বপন। এ ছাড়া সাবেক যুবদল নেতা মিজুর সঙ্গে রাজনৈতিক মতভেদের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর অনেকে ক্ষিপ্ত ছিলেন।
মিল্লাতের ভাই শরীফ উদ্দিন জানান, হামলাকারীদের মুখে মাফলার, মাস্ক, রুমাল পরা ছিল। তিনি বলেন, সবাই মুখ ঢেকে থাকলেও তিনি একজনকে চিনেছেন। এলাকায় তাঁকে সবাই 'টাইগার' বলে ডাকেন। তাঁর প্রকৃত নাম জানা নেই। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, কার কাছে মামলা করব। সবাই তো তাদেরই লোক। পুলিশ যদি মামলার বিষয়ে সহযোগিতা করে, তাহলে মামলা করব।

ওয়ারী থানার ওসি কবির হোসেন হাওলাদার সমকালকে বলেন, রাতে ওয়ারী এলাকার অজ্ঞাতপরিচয় ৮-১০ লোক ওই বাসায় গিয়ে মিল্লাত হোসেনের ছেলেকে খুঁজলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। উত্তেজিত হয়ে পড়ে গিয়ে তিনি আহত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে মারা যান। ওসি বলেন, মিল্লাত হোসেনের ছোট ভাই স্বপন বিএনপি নেতা। পল্টনে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকায় কয়েকজন তাঁকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাঁকে পল্টনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক দেখানো হয়েছে। ওসি জানান, মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা কোনো অভিযোগ করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে আমরা প্রকৃত কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করেছি।

মিল্লাত হোসেনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল) মর্গে আনা হলে সেখানে উপস্থিত হন তাঁর ছেলে ফয়সাল মেহবুব মিজু। তাঁর দাবি, ঘটনাটি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মান্নাফির নেতৃত্বে হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁকে মারার জন্য বাসায় গিয়েছিল। না পেয়ে ক্ষোভে তাঁর বাবাকে মাথার পেছনে আঘাত করলে তিনি মারা যান। তাঁর বাবা নিরপরাধ এবং কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না জানিয়ে মিজু বলেন, 'জানি, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পাব না। তবুও বাবা হত্যার বিচার চাইছি।'

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মান্নাফি সমকালকে বলেন, তিনি (মিল্লাত) সম্মানিত লোক ছিলেন। গত শুক্রবারও তাঁরা দু'জন এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এতে তাঁর জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। দলীয় কোন্দল বা অন্য কারণে এ ঘটনা ঘটেছে।



বিষয় : আমার স্বামীর কী দোষ ছিল

মন্তব্য করুন