- বাংলাদেশ
- পণ্ডিত পরিবারের ১৮ শহীদ স্বীকৃতির অপেক্ষায়
শহীদ পরিবারের জীবনযুদ্ধ : ৯
পণ্ডিত পরিবারের ১৮ শহীদ স্বীকৃতির অপেক্ষায়

শহীদ ফাতেমা খাতুন লিছুর পরিবারের সদস্যবৃন্দ
কুষ্টিয়া সদর থেকে ২৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ভেড়ামারা উপজেলা। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পাকশী ব্রিজ পার হয়ে পদ্মা নদীর পশ্চিম তীরে ভেড়ামারায় উপস্থিত হয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী।
তখন দিজ্ঞ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকে গ্রামবাসী। চণ্ডীপুর পণ্ডিত বাড়ির প্রায় ৩০ জন পালিয়ে পশ্চিমে চন্দনা নদীতীরে জঙ্গলের মধ্যে একটি ঢালে আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানিরা। পরদিন শুক্রবার সেই ঢালে অতর্কিতে হামলা চালায় হানাদাররা। নির্মমভাবে ব্রাশফায়ারে ১৪ জনকে হত্যা করে। নিহতরা সবাই পণ্ডিত ফতেহ আলীর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও সেই লোহমর্ষক নির্মম হত্যাযজ্ঞ স্মরণ করে শোকবিধুর হন চণ্ডীপুরবাসী। গণহত্যার স্মৃতি ও শ্রুতি এখনও ফিকে হয়ে যায়নি স্থানীয়দের মানসপট থেকে। জনগণ উদ্যোগ নেওয়ায় প্রশাসনের তরফ থেকে ২০১৮ সালে চণ্ডীপুর বধ্যভূমিতে শহীদদের নামসহ স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কেউ শহীদ বা মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। পরিবারগুলো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা দিলেও তা ফাইলচাপা পড়ে আছে।
শহীদ মীর জালাল উদ্দিন আহমেদের ছেলে মীর শওকত আজিজ মিঠু সমকালকে বলেন, 'শহীদদের মধ্যে আমার বাবা, বোন, ছোট ভাই ছিলেন। অন্যরা আত্মীয়স্বজন, অর্থাৎ মামা-মামি, চাচি এবং চাচাতো ও মামাতো ভাইবোন। বহুবার চেষ্টা করেছি তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য। মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছি। বহু চেষ্টা করছি। কেউ শুনছে না।'
ভেড়ামারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুর রহমান বলেন, '১৯৯০ সাল থেকে শহীদ পরিবারগুলো স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করছে। আমরা তাদের আবেদনগুলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর পর আর অগ্রগতি হয়নি।'
বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নজরে নেওয়া হলে তিনি সমকালকে বলেন, 'কী ধরনের আবেদন, কবে করেছেন- এগুলো না দেখে বলা যাবে না। তাঁরা সবাই গণশহীদ, না তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাও আছেন- এগুলো দেখতে হবে। আবেদনগুলো নজরে এলে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর পাবনার ঈশ্বরদী দখল করে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার দিকে এগোতে থাকে। প্রবল প্রতিরোধ গড়েও সমরাস্ত্রের অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পশ্চিম মাথার ইপিআর ক্যাম্প দখল করে ১৫ এপ্রিল পদ্মা নদী পার হয়ে রাতে আসে ভেড়ামারা উপজেলায়। খবর পেয়ে গ্রামবাসী পালাতে থাকে। প্রায় ৩০ জন পালিয়ে পশ্চিমে চন্দনা নদীতীরে জঙ্গলের একটি ঢালে আশ্রয় নেন। ১৬ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি সেনারা চন্দনা নদী পার হয়ে হিড়িমদিয়া গ্রামের দিকে রওনা হতে চেষ্টা করে।
চন্দনা নদীর তীরে পণ্ডিত পরিবারের ফতেহ আলী পণ্ডিতের কন্যা ও মীর জালালের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সাজেদা বেগমের প্রসব বেদনা দেখা দেয়। আশপাশে পাকিস্তানি সেনারা আছে কিনা, তা দেখতে সাইকেলে মীর আবুল হোসেনের ছেলে আক্তারুজ্জামান বাবলু জঙ্গল থেকে বের হন। তখন বাবলুর অজান্তে পিছু নিয়ে ঝোপ-জঙ্গলে এসে চন্দনা নদীর পাড়ে ব্রাশফায়ার করে হানাদাররা। অন্তঃসত্ত্বা সাজেদা বেগমের পেটে গুলি লেগে গর্ভপাত ঘটলে প্রচুর রক্তক্ষরণের পরও তিনি বেঁচে যান। তবে পণ্ডিত পরিবারের ১৪ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। শহীদ সন্তান ও যুদ্ধাহত জাহানারা খাতুন, আফেরাজা বানু, আমির খসরুসহ পন্ডিত পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
শহীদরা হলেন- ফতেহ আলী পণ্ডিতের ছেলে আনসার কমান্ডার শফিউদ্দীন ও তাঁর ছেলে মশিউর রহমান খুশি; শামসুদ্দিনের ছেলে সদরুল ইসলাম সদু, দলিল উদ্দীনের স্ত্রী জাহিদা খাতুন ও কন্যা সেলিনা খাতুন, আতিয়ার রহমানের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন লিছু, আবুল হোসেনের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন, মীর আবুল হোসেনের ছেলে আক্তারুজ্জামান বাবলু, ডায়মন্ড, মীর সাখাওয়াত হোসেন নতুন, আব্দুস সাত্তারের কন্যা নীলা, মীর ফকির উদ্দীনের ছেলে মীর জালাল উদ্দীন, মীর জালালের কন্যা রুবী এবং ওই দিনই ভূমিষ্ঠ মীর জালাল ও সাজেদা বেগমের নবজাতক। পণ্ডিত পরিবারের চারজন গুলিবিদ্ধ হন। ফতেহ আলী পণ্ডিতের মেয়ে সাজেদা বেগম, নাতি মো. আমির খসরু, নাতনি আফরোজা বানু ও জাহানারা খাতুন। শহীদ ১৪ জনকে পরে পণ্ডিত পরিবারের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে গ্রামবাসী।
শহীদ ফাতেমা খাতুন লিছুর বড় ছেলে যুদ্ধাহত মো. আমির খসরু, তিনি বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের কুষ্টিয়া জোনাল অফিসে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। সমকালকে তিনি বলেন, 'বঙ্গবন্ধু শুধু আমাদের পরিবারের ১৪ জন শহীদের নামে পরিবারপ্রতি ২ হাজার টাকা করে ১০ হাজার টাকা অনুদান এবং সমবেদনাপত্র দিয়েছিলেন। আর কোনো সরকার আমাদের খোঁজ নেয়নি।' তিনি আরও বলেন, 'শহীদদের তালিকা করা হোক। যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের তালিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হবে না- এটা মেনে নেওয়া যায় না।'
পণ্ডিত ফতেহ আলীর পরিবারের আরও চারজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাঁরা হলেন ফতেহ আলীর মেয়ের জামাইয়ের বড় ভাই মীর ছফিরউদ্দিন আহম্মেদ, দুই ছেলে মীর আসাদুজ্জামান বাবু ও মীর আব্দুর রশিদ দুলাল এবং ভাইয়ের ছেলে রানু। ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পর ভেড়ামারা মুক্ত হয়। এর দুই দিন পর শুক্রবার জুমার নামাজের আগে উপজেলার রথপাড়া গ্রামে হঠাৎ করে পণ্ডিতের আরও তিন ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী।
শহীদ মীর ছফির উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে মীর সফিউল আলম মজনু সমকালকে বলেন, '১০ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী এলাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় পথে রথপাড়ায় আমাদের বাড়িতে অপারেশন করে। তখন বাড়ির ভেতরে আমার বাবা ও দুই চাচাকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে লাশ কবরে ফেলে যায়।' তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এপ্রিলে ঈশ্বরদীতে ছফির উদ্দিন আহম্মেদের ভাইয়ের ছেলে রানুকে বিহারিরা হত্যা করে।
মন্তব্য করুন