- বাংলাদেশ
- অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই
অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস আজ

উদাসীনতা ও উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় অনিয়ম, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, সরকারি-বেসরকারি খাতের অর্থ লোপাটের ঘটনা এখন ব্যাপক রূপ নিয়েছে। টানা তিনবার ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিকে চিরতরে নির্মূল করা যায়নি। বরং সরকারের ছত্রছায়ায় আরও পোক্ত হয়েছে দুর্নীতিবাজরা। ব্যাংকিং খাতের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ছে। অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করা, আইনের আওতায় আনা, পাচার অর্থ ফেরত আনার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। ফলে দুর্নীতিবাজদের পাচার অর্থে চাঙ্গা হচ্ছে ভিন দেশের অর্থনীতি।
এমন প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে এবার জাতিসংঘের ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন (আনকাক) প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব।' সংস্থাটি বলেছে, দুর্নীতির কারণে বিশ্ব আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশ্বজুড়ে মানুষের সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ এখন সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে। এই পরিস্থিতে দুর্নীতি দূর করতে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
দিবসটি পালন উপলক্ষে আজ শুক্রবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মো. মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা ও পাচার অর্থ ফেরত আনতে নানামুখী তৎপরতা জোরদার করেছে দুদক। তারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাচার অর্থ ফ্রিজ ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান অব্যাহত রয়েছে। মানি লন্ডারিং আইনে দুদককে আরও ক্ষমতা দেওয়া হলে অর্থ পাচার রোধে তৎপরতা জোরদার করা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুইস ব্যাংক ছাড়াও দেশ থেকে অর্থ পাচারের অন্যান্য আরও গন্তব্য রয়েছে। ওইসব গন্তব্যে প্রতি বছর সুইস ব্যাংকে জমানো অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্রদ্ব, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ রয়েছে। এ ছাড়া তথাকথিত 'করস্বর্গ' হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অনেক অফশোর অঞ্চলে অর্থ পাচার ক্রমবর্ধমান হারে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন সংস্থার বিশ্নেষণের মাধ্যমে জানা গেছে, দুর্নীতির শেকড় ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সব খাতের দুর্নীতির সূচকগুলো ঊর্ধ্বগামী। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের দুর্নীতির সূচক চরম হতাশাজনক। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে দেশকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। তবে বিদেশে দুর্নীতিবাজদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকে জমানো অর্থের তথ্য সরকারের নজরে এলেও এসবের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজদের ধরা ও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
গত বছরের জানুয়ারিতে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের স্কোর ০-১০০ স্কেলে অপরিবর্তিত থেকে ২৬ হয়েছে। গত এক দশকের স্কোরের বিশ্নেষণে ২৬-এ থাকা এবং সার্বিকভাবে অবস্থানের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না হওয়া দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা প্রমাণ করে। গত বছরের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী ২০২০ সালের তুলনায় এক ধাপ উন্নতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। আর সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী এক ধাপ পিছিয়ে ১৪৭তম।
টিআইবির গত বছরের জাতীয় খানা জরিপেও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। টিআইবি বলেছে, শুধু সেবা খাতে ঘুষের শিকার হয়ে সেবাগ্রহীতাদের যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, তার প্রাক্কলিত পরিমাণ বার্ষিক জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
সুইজারল্যান্ডের সর্বশেষ এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশিরা আট হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিভিন্ন সুইস ব্যাংকে জমা করেছেন।
২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার সমান। এই হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে ৮০ হাজার কোটির বেশি টাকা।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচার হওয়া মোট অর্থের মধ্যে ৮০ ভাগই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বৃহৎ অঙ্কের কর ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চালান জালিয়াতির মাধ্যমে বছরে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) যথাক্রমে বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ পাচার রোধে দুটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে দুদক। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তি অর্থ পাচার ও সংশ্নিষ্ট অপরাধে জড়িত- এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাচারকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, ওই দেশের সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনের আলোকে পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ চিহ্নিত ও ফ্রিজ করে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা।
মন্তব্য করুন