- বাংলাদেশ
- রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাড়বে অর্থনৈতিক সংকট
রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাড়বে অর্থনৈতিক সংকট
বিশ্নেষকদের অভিমত

ইউরোপে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কালো ছায়ায় বাংলাদেশও সংকটে আছে। এর মধ্যে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক বছর আগেই রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ আরও বিপদের সংকেত দিচ্ছে। দেশের অগ্রণী নাগরিক, রাজনীতি-অর্থনীতির বিশ্নেষকরা হুঁশিয়ারি দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসে বিরোধ নিষ্পত্তি করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। অন্যথায় অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে জনগণের কষ্ট বাড়াবে।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের দ্বন্দ্ব বুধবার নয়াপল্টনে রক্তাক্ত সংঘর্ষে গড়ায় ও পুলিশের গুলিতে একজনের প্রাণ যায়। আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর পূর্বঘোষিত সমাবেশ কর্মসূচি নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আরও সংঘাত-সংঘর্ষ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে।
'নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা' নিয়ে বড় দুই রাজনৈতিক শক্তির পুরোনো মতবিরোধ নতুন করে সংঘাতের সৃষ্টি করছে। এই সমস্যার সমাধান তথা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব। এটিই বলছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
তাঁদের অনেকে বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট সাধারণ মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে দুর্ভোগ। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতিদিরা পথ দেখানোর পরিবর্তে মানুষের জীবনে নতুন সংকট সৃষ্টি করছেন।
বছরের মধ্যভাগে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদ, দলের প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনকালে দলনিরপেক্ষ সরকার প্রভৃতি দাবিতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আন্দোলন শুরু করলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজপথে ৫ আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়। বিভাগীয় নগরগুলোতে গণসমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে সরকারি দলের তরফ থেকে কৃত্রিম পরিবহন ধর্মঘটসহ নানারকম বাধা পেলেও সমাবেশগুলো বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে করতে পেরেছে। তবে মধ্যস্তরের নেতারা উত্তেজক প্রচার চালিয়ে পরিস্থিতি তপ্ত করে তোলেন। সরকারি দলও অসহিষ্ণু হয়। ঢাকার সমাবেশের আগেই এক দফা সংঘর্ষের পর বুধবার রাতে নয়াপল্টনে বিএনপির সদরদপ্তর পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে বর্ষিয়ান প্রাজ্ঞ নাগরিক প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, সারাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের গভীর শঙ্কা বিরাজ করছে। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে আশঙ্কার মধ্যেই বুধবার বিকেলে একজন নিহত হবার খবর গণমাধ্যমে এলো। একদল সমাবেশ করবে, আরেক দল বাধা দেবে। এই রাজনীতি বুর্জোয়া রাজনীতি। সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণ এতে নেই- এটিই প্রমাণিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, বুর্জোয়া রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য থাকে যেনতেনভাবেই হোক ক্ষমতায় যাওয়া এবং তা কুক্ষিগত করে রাখা। এতে সমাজ পরিবর্তনের, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো বিষয় নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সমাজ পরিবর্তনের। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা সেখানে বলা হয়েছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নানা সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ এবং পুরো বিশ্ব। রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা আসন্ন, খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রয়েছে বিদ্যুৎ সংকট, ডলার সংকট, কর্মসংস্থানের সংকট। জীবনধারণের সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, যাতায়াত খরচ বৃদ্ধিসহ নানা সংকট যখন সাধারণ মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তখন দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত। আর তাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন।
তিনি বলেন, মানুষ হানাহানির রাজনীতির প্রশমন কেবল চায় না, এ থেকে পরিত্রাণও চায়। তাদের এ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিতে হবে। সেজন্য দরকার বিকল্প রাজনীতি গড়ে তোলা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে বুধবার ফোনে বলেন, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় খেটে খাওয়া মানুষেরাই বেশি বিপদে পড়ে যায়। তিনি বলেন, 'আমরা চাই, রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ যেন শান্তিপূর্ণভাবে হয়। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়। কারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জীবিকা নির্বাহের তাগিদে প্রতিদিনই কাজ করতে হয়। বিশৃঙ্খলা হলে এসব স্বল্প আয়ের মানুষ বিপদে পড়ে যাবে।'
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, করোনা-পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বর্তমানে সারাবিশ্বে মূল্যস্ম্ফীতি বেড়েছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। দেশের অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত অপ্রত্যাশিত কোনো কিছু ব্যবসায়ীরা চান না। সব পক্ষকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার দিকে সবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন সবকিছু দ্রুত ঠিক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বর্তমানে যারা ঢাকায় সমাবেশ করতে চান, তাঁরা দেশের অন্য অঞ্চলেও করেছেন। সেগুলোতে কোনো সমস্যা হতে দেখা যায়নি। আশা করি ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাঘাত ঘটবে- এমন কিছু হবে না। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ব্যবসায়ীরাও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেটি প্রত্যাশা করেন।
সংশ্নিষ্টদের মতে, বিএনপির ডাকে বিভাগীয় শহরগুলোতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হলেও ঢাকার ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগের অবস্থানের পেছনে রাজনৈতিক অনেক হিসাব-নিকাশ রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সমাবেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণ বিএনপি নিজেই এই সমাবেশ নিয়ে তাদের আলাদা কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে আগেই জানিয়েছে। তারা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চায় বলে আওয়ামী লীগ মনে করছে।
বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ৮ অক্টোবর মন্তব্য করেন, ১০ ডিসেম্বর সরকারের পতন হবে। সেদিনের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ কেউ এই সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিরও ঘোষণা দেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২২ নভেম্বর বলেছেন, 'এখনও আমরা আসল ঘোষণা তো দেই নাই। আসল ঘোষণা আসবে ১০ তারিখে। সেদিন থেকে শুরু হবে এক দফার আন্দোলন।'
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের একটি সম্মেলনে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা সন্ত্রাস করবে। আবার আগুনসন্ত্রাস ফিরে আসছে। খেলা হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারা দেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
হঠাৎ করেই একটি সমাবেশকে ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানকে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংঘাত কোনো পরিস্থিতিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বড় দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এই আচরণ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উভয়পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেও কক্সবাজারের সমাবেশে সমস্যা সমাধানে আলোচনার কথা বলেছেন। তাই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন