- বাংলাদেশ
- খুন নয়, আত্মহত্যা করেছেন বুয়েট ছাত্র ফারদিন
ডিবি পুলিশের দাবি
খুন নয়, আত্মহত্যা করেছেন বুয়েট ছাত্র ফারদিন

ফারদিন নূর পরশ খুন হননি। একাডেমিক পরীক্ষায় খারাপ ফলের বিতৃষ্ণা আর বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে স্পেন যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকেই আত্মহননের পথে হাঁটেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এ ছাত্র। তিনি স্বেচ্ছায় রাজধানীর সুলতানা কামাল ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্নেষণ করে গতকাল বুধবার রাতে এমন তথ্য হাজির করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ডিবির দাবি, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ও আশপাশের আলামত বিশ্নেষণ করে এ তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। তবে ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনার ভিসেরা প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি। ডিবির ভাষ্য, ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়া গেলে চিকিৎসক এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ মতামত দেবেন।
তবে ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন- এমন দাবি মানতে নারাজ বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা। গত রাতে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'যে ব্যক্তি ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সে ফারদিন কিনা তা নিশ্চিত না। ফারদিন রামপুরা থেকে যাত্রাবাড়ী গেল কী করে? এর কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।'
এদিকে মৃত্যুর কারণ নিয়ে নতুন তথ্য সামনে আসার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছেন ফারদিনের সহপাঠীরা।
গত রাতে কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ফারদিনের মৃত্যুর পর তাঁর পারিবারিক সূত্র, অধিকতর তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্নেষণ, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়। ৪ নভেম্বর বিকেল ৩টায় ডেমরার কোনাপাড়া নিজ বাসা থেকে পরীক্ষার কথা বলে বুয়েটের হলের উদ্দেশে বের হন ফারদিন। বিকেল ৫টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে বান্ধবী বুশরার সঙ্গে তিনি দেখা করেন। নীলক্ষেত, ধানমন্ডিসহ আশপাশ এলাকায় তাঁরা ঘোরাঘুরি করেন। পরে সাতমসজিদ রোডের একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা দেন। রাত ৮টার দিকে টিএসসিসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। এক পর্যায়ে রিকশায় চড়ে রামপুরায় যান। রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় রিকশা থেকে নামেন ফারদিন। সেখানে বান্ধবীকে নামিয়ে কিছু সময় রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ঘোরাফেরা করেন। র্যাবের প্রযুক্তিগত বিশ্নেষণে দেখা যায়, রামপুরার পর কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, বাবুবাজার ব্রিজ-সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার জনসন রোড, গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় যান তিনি।
র্যাবের ভাষ্য, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্নেষণ করে তাঁরা পেয়েছেন- ফারদিন ওইদিন রাত ২টা ১ মিনিটে যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা থেকে লেগুনায় ওঠেন। রাত আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের অন্য পাশে তারাব বিশ্বরোডের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লেগুনা থেকে নামেন। রাত ২টা ২৬ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাব প্রান্তে তাঁর অবস্থান ছিল। রাত ২টা ৩৪ মিনিটে ওই ব্রিজের প্রায় মাঝখানে আসেন ফারদিন। র্যাব বলছে, ব্রিজের তারাব প্রান্ত থেকে সুলতানা কামাল ব্রিজের মাঝখান পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ৪০০-৫০০ মিটার। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের রেলিং ক্রস করেন তিনি। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের ওপর থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেন। ঝাঁপ দেওয়ার পর রাত ২টা ৩৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়েন ফারদিন। রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া রাত ২টা ৫১ মিনিটে ফারদিনের হাতের ঘড়িতে পানি ঢুকে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
র্যাব জানায়, সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টসহ অন্য আলামত বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ফারদিন স্বেচ্ছায় সুলতানা কামাল ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছেন। তদন্ত কার্যক্রম চলমান। ফারদিনের মৃত্যুসংক্রান্ত অন্য কোনো সূত্র বা আলামত পাওয়া গেলে তা বিবেচনায় নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কার্যক্রম চালাবেন।
এর আগে ডিবিপ্রধান ডিআইজি হারুন অর রশিদ সমকালকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেখেছি। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি। সব মিলিয়ে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটি আত্মহত্যা। সুরতহাল প্রতিবেদনে কোনো আঘাতের দাগ পাওয়া যায়নি।
মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন থাকার ব্যাপারে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ফারদিন ঝাঁপ দিয়ে পিলারের গোড়ায় পড়েছিলেন। যে কারণে মাথায় পিলারে আঘাত লাগতে পারে। এ ছাড়া ওপর থেকে পড়ার কারণে বুকে আঘাতও পেতে পারেন।
শুরু থেকে বলা হচ্ছে, চনপাড়ায় গিয়েছিলেন ফারদিন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্নেষণে তাঁর ব্যবহূত মোবাইল ফোনের অবস্থান চনপাড়ার আশপাশের টাওয়ারের আওতায় ছিল। চনপাড়ার মাদক কারবারিরা নির্জন স্থান থেকে মানুষকে ধরে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয় এবং আটকে রেখে মারধর করে। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটে। ওই এলাকাকেন্দ্রিক কাজ করতে গিয়ে চায়ের দোকানদার এক নারীসহ অনেকেই র্যাবের গোয়েন্দাদের জানায়, ৪ নভেম্বরের আশপাশের তারিখে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। তবে তাঁরা সুনিশ্চিতভাবে তারিখ বলতে পারছেন না। এলাকার লোকজনের বক্তব্য অনুযায়ী নভেম্বরের ৩ কী ৫ তারিখে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল। এ কারণে এ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে আমরা কাজ করেছি।'
আত্মহত্যা করার কারণ কী- এমন প্রশ্নে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, 'আমি আত্মহত্যার কথা বলিনি। বলছি সুলতানা কামাল সেতুর রেলিং থেকে স্বেচ্ছায় ফারদিন পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। এটি অ্যাডভেঞ্চার নাকি অন্য কোনো কারণে তা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্তে উঠে আসবে।' সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ফারদিনের চেহারা স্পষ্ট কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সিসি ক্যামেরা অনেক দূরের। চেহারা বোঝার উপায় নেই।'
গত ৪ নভেম্বর রাতে নিখোঁজ হন ফারদিন। পরদিন পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হয়। এর তিন দিন পর গত ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক বলেছিলেন, ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের দাগ রয়েছে। মারা যাওয়ার আগে তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতনও করা হয়। লাশ উদ্ধারের দুই দিন পর ১০ নভেম্বর ফারদিনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাসহ অচেনা কয়েকজনকে আসামি করে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা করেন ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা। ফারদিনের বাবাও শুরু থেকে বলে আসছেন, 'এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।'
এদিকে ফারদিনের মৃত্যুর পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাত দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য গণমাধ্যমে আসে। চনপাড়াকেন্দ্রিক মাদক গ্যাংয়ের নামও উঠে আসে। ওই বস্তির রায়হান গ্যাং জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, ৪ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টা ৩৫ মিনিটে ফারদিনের অবস্থান ছিল চনপাড়া বস্তি এলাকায়। পরে চনপাড়ায় অভিযানও চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ঢাকার ভেতরে খুন হয়ে থাকতে পারেন ফারদিন। তদন্তের গ্রহণযোগ্য অগ্রগতি না দেখে নানামুখী বক্তব্যে ফারদিনের পরিবার ও তাঁর সহপাঠীরা নানা সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কেন আত্মহত্যার ধারণা :পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বেশ কিছু কারণে ফারদিন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। ডিবির পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়, বুয়েটে তাঁর একাডেমিক ফল ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল। প্রথম সেমিস্টারে ৩.১৫ পেলেও কমতে কমতে তা ২.৬৭-এ নেমে আসে। এটা পরিবারের লোকজন জানতেন না। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে স্পেন যাওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকা প্রয়োজন ছিল। তা জোগাড় করতে পারছিলেন না। বন্ধুরা ৪০ হাজার টাকা দেয়। নিজে টিউশন করতেন চারটি। সব টাকা দিয়ে ফারদিন নিজে ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনায় খরচ করতেন। পুলিশ বলছে, বাসায় তাড়াতাড়ি ফেরার ব্যাপারে শাসন করা হতো। হলে থাকা যাবে না- এটা বলা হতো। এক ধরনের চাপের মধ্যে ছিলেন তিনি। যেটা তিনি মানতে পারেননি। এর আগে ফারদিনের বাবা বলেছিলেন, 'তাঁর ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। ফারদিন পরিবারের অনেক উত্থান-পতন দেখেছে। সে প্রতিটি পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। ফারদিন একজন যোদ্ধা।'
ডিবির ভাষ্য, ফারদিনের মানসিক অবস্থা হয়তো ভালো ছিল না। আরেক বান্ধবীর সঙ্গে মেসেঞ্জার ও টেলিগ্রামে তাঁর অনেক কথোপকথন রয়েছে। ডিবি বলছে, ওই কথোপকথনে হতাশার কথা অনেকবার বলেছেন ফারদিন। প্রথমে তিনি হয়তো বাবুবাজার ব্রিজ টার্গেট করেন। ওই এলাকা ব্যস্ত থাকায় সেখান থেকে ফেরত আসেন। বুশরাকে ৯টা ৪৫ মিনিটে রামপুরা এলাকায় নামিয়ে দেওয়ার পর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ান ফারদিন।
মন্তব্য করুন