শীতের কুয়াশা ভেদ করে ভোরের প্রথম কিরণছটা যখন চারপাশ আলোকিত করে, ঠিক তখনই হাজারো মানুষের কোলাহলে জেগে ওঠে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। এ সময় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন জাতির সূর্যসন্তানরা। সর্বস্তরের মানুষের অর্ঘ্যে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতির মিনার। গতকাল বুধবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষরা শপথ নেন বুদ্ধিজীবীদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার। ধিক্কার জানান তাঁদের ঘাতকদের। একই সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত প্রণয়ন ও প্রকাশের দাবি জানান তাঁরা।

গতকাল সকাল থেকেই জাতির এই সূর্যসন্তানদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষ। ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধও। শোকে আপ্লুত হাজারো মানুষ বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের মর্মন্তুদ যন্ত্রণার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, কবরস্থান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতিস্তম্ভে নিবেদন করেছেন প্রাণের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

স্বজনহারা মানুষের বুকের ভেতর চেপে রাখা কান্নায় ভিজে ওঠে বেদিমূল।

৫১ বছর আগের এই দিনে, দেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের স্থানীয় সহযোগী আলবদর, রাজাকার ও আলশামসের সঙ্গে যোগসাজশে দেশের সবচেয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। সদ্য উদীয়মান বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দেয়।

জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে বুধবার সূর্যোদয়ের ক্ষণে দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার পাশাপাশি শোকের প্রতীক কালো পতাকাও উত্তোলন করা হয়েছিল। দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে পতাকা উত্তোলন, শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, স্বেচ্ছায় রক্তদান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রভৃতি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়।

দিনটি উপলক্ষে সকাল ৭টা ৫ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল এই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করে। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। পরে রাষ্ট্রপতি সেখানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের খোঁজখবর নেন।
দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আরেকটি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে স্বাধীনতার মহান স্থপতির প্রতি সম্মান জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিনি মহান নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে আরেকটি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও সকালে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. শামসুল হক টুকু এবং চিফ হুইপ ও হুইপদের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ও পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও আফজাল হোসেন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর ও দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।

শ্রদ্ধা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা এখনও সক্রিয়। বিদেশে যারা পলাতক রয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ সময় তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে। আর বিএনপি এই ১০ তারিখে তাদের কর্মসূচি পালন করেছিল। আবারও একাত্তরের পরাজিত শক্তি প্রতিশোধ নিতে চাইছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে এই ষড়যন্ত্র পরাহত করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ?আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। এই তালিকা নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি আছে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা আমরা করেছি। এ ছাড়া নতুনভাবে আরও ১০০ আবেদন জমা পড়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল জামায়াতে ইসলামী। আর তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর নীলনকশা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, গুম শুরু হয়েছিল। সেই ১০ ডিসেম্বরকেই এবার সমাবেশের জন্য বেছে নিয়েছিল বিএনপি। যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের ইতোমধ্যে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন আজও বাস্তবায়ন হয়নি এ দেশে। গত ১৪ বছরে এ দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে। ন্যায়বিচার ধ্বংস করে দিয়েছে এই সরকার।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দেশে বাকস্বাধীনতা নেই। মানুষের খাওয়া-পরার অধিকার আজও নিশ্চিত করা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে কারণে জীবন দিয়েছিলেন, শাহাদাতবরণ করেছিলেন- সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও দর্শন নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের যারা হত্যা করেছিল, তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপিকে আজকের প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে।
শহীদ পরিবারের সদস্যদের চাওয়া :মিরপুর ও রায়েরবাজারে স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর বলেন, 'বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে জানানো হয়নি। জাতি জানতে চায়, সরকার কেন তাদের ফিরিয়ে আনতে পারল না।'

বুদ্ধিজীবী সৈয়দ মোর্শেদ আলীর সন্তান তাহমিনা খান বলেন, '১৪ ডিসেম্বরের বীভৎসতার স্বীকৃতি আমাদের দাবি। স্বজনদের রক্তের দাবি আমরা ছাড়ব না। সেই গণহত্যার কথা পৃথিবীতে তুলে ধরুন। পরবর্তী প্রজন্মও যেন এই দাবিতে সোচ্চার থাকে।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, 'রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যারা রাজনীতি করে, তারা এ দেশের মাটিতে কোনো ধরনের পদে আসতে পারবে না।'

বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন :মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে আরও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, কমরেড খলীকুজ্জমান, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও পেশাজীবী নেতারা।

শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরসহ নানা সংগঠন।

এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রতীকী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে ছিল যন্ত্রসংগীত, গান, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি অনুষ্ঠান।



বিষয় : বিনম্র শ্রদ্ধায় সূর্যসৈনিকদের স্মরণ

মন্তব্য করুন