ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

নতুন-পুরোনো মামলার জালে বিএনপি

ফখরুলদের জেলজীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে

ফখরুলদের জেলজীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে

কামরুল হাসান

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪:০৭

হোক সেটা পুরোনো, কিংবা নতুন। মামলার বৃত্ত থেকে যেন বেরোতেই পারছে না বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারাও বাদ যাচ্ছেন না মামলার ফাঁদ থেকে। পুরোনো মামলা তো আছেই, এখন উজ্জীবিত বিএনপিকে ঠেকাতে নতুন মামলা ঠুকে বোতলবন্দির চেষ্টা চলছে। মামলার রোষে পড়ে আদালত আঙিনায় নেতাকর্মীর এখন নিত্যচক্কর। প্রিয় রাজনীতির মাঠকে আপাত বিদায় বলে দলটির অনেক শীর্ষ নেতার ঠাঁই কারাগারে। পুরোনো মামলায় জামিনে থাকলেও নতুন মামলায় ভুগতে হচ্ছে অনেককে। মামলায় অচেনা আসামির তালিকায় জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কারও কারও নাম। সারাদেশে পেন্ডিং মামলায় শোন অ্যারেস্টের ঘটনাও পেয়েছে গতি।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত আগস্ট থেকে সারাদেশে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। গত ১২ অক্টোবর থেকে একই দাবিতে ১০ বিভাগীয় নগরে গণসমাবেশও করে দলটি। গেল ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগের গণসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি প্রথম ধাপের আন্দোলনে যবনিকা টানে। আন্দোলনের এ সময়ে সারাদেশে পাঁচ শতাধিক মামলায় কয়েক হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। আসামি করা হয়েছে অর্ধলক্ষাধিক নেতাকর্মীকে। অচেনা আসামি আরও কয়েক হাজার।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সরকার ভীত হয়ে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন শুরু করেছে। এসব করে শেষ রক্ষা হবে না। জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে। গণঅভ্যুত্থানেই এই সরকারের পতন হবে।

ঢাকার গণসমাবেশ ঘিরে গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীর রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। এতে একজন নিহত ও অর্ধশত আহত হন। সংঘর্ষের পর পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ে হানা দেয়। পরদিন পল্টন, মতিঝিল, রমনা ও শাহজাহানপুর থানায় আলাদা চারটি মামলা করে পুলিশ। এতে ৭২৫ জনের নাম উল্লেখসহ দুই হাজার ৯৭৫ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীসহ আরও অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা রয়েছেন। পুলিশের করা মামলায় নাম উল্লেখ করা নেতাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস ছিলেন না।

'ওপরের নির্দেশে' ওই দুই নেতার বাসায় গত ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। দু'জনকে প্রথমে আটক করে নেওয়া হয় মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে। বাসা থেকে নিয়ে যাওয়ার প্রায় ১১ ঘণ্টা পর মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে ডিবি। তখন ডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছিল, 'পুলিশের ওপর বর্বরোচিত হামলা, উস্কানিদাতা, পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।' পরে তাঁদের পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৯২টি। এর মধ্যে ৩৫টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে উচ্চ আদালতে। বাকিগুলো চলমান। গত ৮ ডিসেম্বর রাতে আটক হওয়ার দুইদিন আগেও ময়লার ট্রাকে অগ্নিসংযোগের মামলায় তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছিলেন। পল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় কয়েক দফা জামিনের আবেদন করেও লাভ হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবারও তৃতীয় দফায় জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যায়। মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪টি মামলা রয়েছে। সবক'টি মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন। দলের মহাসচিবের সঙ্গে নতুন মামলায় তিনিও কারাবন্দি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের বিরুদ্ধে ৩৭টি পুরোনো মামলা রয়েছে। নয়াপল্টনের ঘটনায় নতুন করে তিনি একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে সারাদেশে আগে থেকেই দুই শতাধিক মামলা রয়েছে। নয়াপল্টনে সংঘাতের দুইদিন আগেও এক মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ওই সংঘর্ষের পর নতুন করে তাঁর নামেও একাধিক মামলা হয়েছে। যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা রয়েছে। নতুন করে তিনিও একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলা রয়েছে ১১৩টি। সব মামলায় তিনি জামিনে থাকলেও নতুন করে মামলার আসামি হয়েছেন তিনি।

গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনের বিরুদ্ধেও আগে ৮০টির মতো মামলা রয়েছে। সবক'টি মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন। ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের ভেন্যু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী কাজ করছিলেন। সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে সমঝোতার জন্য তিনি প্রশাসনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সংঘর্ষের দিনও তিনি ডিএমপির সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। পথে তাঁকে আটক করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আগে ১০৫টি মামলা ছিল। সবক'টি মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন। নতুন করে নয়াপল্টনের মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জানান, নতুন মামলায় অচেনা আসামি জুড়ে দেওয়ায় বিএনপি নেতাদের হয়রানি করার পথকে সহজ করা হয়েছে। আদালত থেকে একটি মামলায় জামিন হলে অন্য মামলায় শোন অ্যারেস্ট দেখানোর অপকৌশল রয়েছে প্রশাসনের হাতে। তাই নতুন মামলায় জামিন হলেই যে সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি মিলবে তা তাঁরা মনে করছেন না। সরকারের যতদিন ইচ্ছা ততদিন আটক রাখার কৌশল হিসেবে এ রকম মামলা করা হয়েছে। এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতনের একাধিক মামলায় জামিন হলেও গত মঙ্গলবার নতুন করে আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আরও অনেককে ওই একই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে আইনজীবীরা জানান।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্টের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল সমকালকে বলেন, আইন যদি প্রভাবিত না হয় তাহলে সবার জামিন নিম্ন আদালতে হওয়া উচিত। দেশবাসী বিচার বিভাগের অবস্থা জানেন। যদি সেখানে ন্যায্য বিচার না পাওয়া যায় তাহলে উচ্চ আদালতের জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছেন।
আইনজীবী ফোরামের আরেক নেতা ব্যারিস্টার আখতার হোসেন বলেন, যে গ্রাউন্ডে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে সেই মামলায় তাঁরা দ্রুত সময়ে জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। তবে হয়রানি করার জন্য তাঁদের জামিন হচ্ছে না।
ফখরুল-আব্বাসের জামিন মেলেনি : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসের জামিন তৃতীয় দফা নামঞ্জুর করেছেন আদালত। রাজধানীর পল্টন থানার মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম মো. তোফাজ্জল হোসেন গতকাল শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এ মামলায় অপর ৫৮ জনের জামিন আবেদনের ওপর শুনানি আগামী রোববার ধার্য করেন আদালত।

এদিন আসামি ফখরুল ও আব্বাসের পক্ষে জামিন চেয়ে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তৃতীয়বারের মতো মির্জা আব্বাসের জামিন নাকচ করেন। এর আগে ৯ ও ১২ ডিসেম্বর দুই দফায় তাঁদের জামিন আবেদন নাকচ করেন আদালত।

আরও চার মামলায় রিজভী গ্রেপ্তার : পল্টন থানার নাশকতার মামলায় কারাগারে থাকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে শাহবাগ থানার চার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন এ আবেদন মঞ্জুর করেন। এ সময় রিজভী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।

আগাম জামিন :এদিকে নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও বিভিন্ন জেলায় নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় প্রায় এক হাজার নেতাকর্মীকে আগাম অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আলাদা আলাদা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম এবং বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল তাঁদের ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। কেন তাদের স্থায়ী জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে সরকারের সংশ্নিষ্টদের প্রতি রুলও জারি করেন আদালত।



আরও পড়ুন

×